ডলার সংকটে বৈষম্যমূলক নীতির দায় কতটা

রিজার্ভ কমে যাওয়া, ক্রমাগত ডলার সংকট— বাংলাদেশে এখন আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয়। বাংলাদেশের ডলার আয়ের প্রধান উৎসের মধ্যে রয়েছে প্রবাসীদের আয় ও রপ্তানি আয়। এর বাইরে ফ্রিল্যান্সাররা প্রতি বছর মোটা অংকের ডলার আয় করেন। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ফেসবুক ও ইউটিউব থেকেও অনেকে ডলার আয় করেন।

রিজার্ভ কমে যাওয়া, ক্রমাগত ডলার সংকট— বাংলাদেশে এখন আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয়। বাংলাদেশের ডলার আয়ের প্রধান উৎসের মধ্যে রয়েছে প্রবাসীদের আয় ও রপ্তানি আয়। এর বাইরে ফ্রিল্যান্সাররা প্রতি বছর মোটা অংকের ডলার আয় করেন। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, ফেসবুক ও ইউটিউব থেকেও অনেকে ডলার আয় করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী টাকার সঙ্গে ডলারের বিনিময় হার একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। দৃশ্যমানভাবেই যা বৈষম্যমূলক। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈষম্যমূলক ডলার নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি অনুযায়ী, প্রবাসীরা যে ডলার পাঠান তার বিনিময় হার ১০৭ টাকা। ব্যবসায়ী ও ফ্রিল্যান্সারসহ অন্যদের জন্য এই হার ১০১ টাকা, যা ব্যবসায়ীদের রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে এখন করা হয়েছে ১০২ টাকা।

প্রবাসীরা তাদের পাঠানো অর্থের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পান। যারা বিদেশে রপ্তানি করেন, তারাও প্রণোদনা পান।

বিনিময় হার সবচেয়ে বেশি পান প্রবাসীরা। সেই হারের সঙ্গেও খোলা বাজারের ডলারের দামের পার্থক্য ৫-৬ টাকা। অর্থাৎ একজন প্রবাসী ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার আনলে প্রণোদনাসহ পাচ্ছেন ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে যা ১১২-১১৪ টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, দেশে গত ডিসেম্বরে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। প্রবাসীরা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন।

২০২১ সালে বিদেশে গেছেন ৬ লাখের বেশি প্রবাসী কর্মী। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২২ সালে এই সংখ্যা ১০ লাখের বেশি হতে পারে। তবে যে হারে প্রবাসীর সংখ্যা বেড়েছে, সেই হারে রেমিট্যান্স বাড়েনি।

সরকারি হিসেবে দেশে সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার আছেন। তবে বেসরকারি হিসেবে এই সংখ্যাটি ১০ লাখের উপরে। ফ্রিল্যান্সাররা প্রতি বছর কত আয় করেন তার সঠিক হিসাব না থাকলেও, ধারণা করা হয় এই পরিমাণ কমপক্ষে ১ বিলিয়ন ডলার। অনেকে মনে করেন, এর পরিমাণ প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। এই আয় প্রতিদিনই বাড়ছে।

ফ্রিল্যান্সার মিজানুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা কষ্ট করে দেশে ডলার আয় করে নিয়ে আসি, কিন্তু আমাদেরকে ন্যায্য বিনিময় হার দেওয়া হয় না। প্রবাসীদের চেয়ে আমাদেরকে ৮-১০ টাকা কম দেওয়া হয়। আমরা যদি সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার নিয়ে আসি, সেখানে ৪-৫ টাকা কম পাই।'

তিনি বলেন, 'অন্যান্য মাধ্যমে লেনদেনে আমাদের কিছু খরচ হয়। এসব খরচ বাদ দিয়েও সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে না এনে গেটওয়েতে আনলে আমরা বেশি টাকা পাই। আমাদের স্মার্ট কার্ড দিয়ে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া কথা বলা হয়েছিল। ব্যাংকের মাধ্যমে বাইরে থেকে আয়ের অর্থ আনলে ৪ শতাংশ প্রণোদনাও দেওয়া কথা ছিল। আমি ২০২০ সালে কার্ড করেছি। কিন্তু ১ টাকা প্রণোদনাও পাইনি, এমনকি কোনো সুযোগ-সুবিধাও পাইনি। এই কার্ড করতে আমার দেড় হাজার টাকা লেগেছে। প্রতি বছর নবায়ন করতে দেড় হাজার টাকা লাগে।'

আমরা যদি সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার নিয়ে আসি, সেখানে বিনিময় হার পাই ৯৯-১০১ টাকা। কিন্তু এই ডলার যদি ওয়াইজের মাধ্যমে নিয়ে আসি, সেখানে পাই ১০৬ টাকার উপরে। ওয়াইজে বিনিময় হার বেশি পাওয়ার কারণে সাধারণত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অনেকেই সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার আনার আগ্রহ হারাচ্ছেন।

— মাহাদী হাসান, ফ্রিল্যান্সার

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ফ্রিল্যান্সার বলেন, 'দেশে কম বিনিময় হারের কারণে অনেকে উপার্জিত ডলার বাইরে নানাভাবে ব্যবহার করেন। অনেকের আত্মীয়-স্বজন বাইরে থাকেন। তাদেরকে ডলার দিয়ে দেশে টাকা নেন।'

তার ভাষ্য, 'কারো আয় যদি ৫ হাজার ডলার হয় এবং তিনি যদি এই ডলার বাইরে বিক্রি করে দেশের চেয়ে বিনিময় হার ১০ টাকা করেও বেশি পান, তাহলে তিনি ৫০ হাজার টাকা বেশি পাবেন। কেউ কি চাইবে এই টাকা হারাতে? আর এতে করে দিন শেষে ক্ষতি কিন্তু দেশেরই হয়। রেমিট্যান্স কমে, রিজার্ভ কমে।'

এই ফ্রিল্যান্সারের মতে, তাদেরকে একটি স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে। এই কার্ড প্রতি বছর নবায়ন করতে দেড় হাজার টাকা দিতে হয়, কিন্তু এর বিন্দুমাত্র সুফল পাওয়া যায় না।

'ব্যাংকের মাধ্যমে বাইরে থেকে আয়ের অর্থ আনলে ৪ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার কথা। কিন্তু ১ পয়সাও দেওয়া হয় না', যোগ করেন তিনি।

ফেসবুকের মাধ্যমে ডলার আয় করা একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি মাসে এক থেকে দেড় হাজার ডলার আয় করি। ব্যাংকিং চ্যানেলে আসা ডলারের বিনিময় হার পাই ১০১ টাকা। এতে আমি প্রতি মাসে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা কম পাচ্ছি। আবার বিদেশ যাওয়ার সময় আমি যদি ডলার কিনতে চাই তখন আমাকে ১১২-১১৪ টাকা দামে কিনতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার চুরি ঠেকাতে পারে না, হাজার বা লক্ষ কোটি টাকা পাচার ধরতে পারে না। আর ডলার আমরা আয় করে এনে দেই, সেই আমাদেরকে বঞ্চিত করা হয়, ন্যায্যমূল্য দেওয়া হয় না। এই অযৌক্তিক বৈষম্যমূলক নীতির কারণে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অনেকেই এখন বিকল্প পথ খুঁজছে।'

ফ্রিল্যান্সার মাহাদী হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা যদি সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার নিয়ে আসি, সেখানে বিনিময় হার পাই ৯৯-১০১ টাকা। কিন্তু এই ডলার যদি ওয়াইজের মাধ্যমে নিয়ে আসি, সেখানে পাই ১০৬ টাকার উপরে। ওয়াইজে বিনিময় হার বেশি পাওয়ার কারণে সাধারণত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া অনেকেই সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার আনার আগ্রহ হারাচ্ছেন।'

আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি ডলারের বিনিময় হারে এই বৈষম্য রাখা উচিত না। ডলার ডলারই। কিন্তু কেউ ১০৭ টাকা পাবে, আবার কেউ ১০১ বা ১০২ টাকা পাবে, তা কোনোভাবেই হতে পারে না। এটি সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। না বুঝে এটা করা হয়েছে। এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে অযথা।

— আহসান এইচ মনসুর, নির্বাহী পরিচালক, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট

বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির চেয়ারম্যান তানজিবা রহমান বলেন, 'ফ্রিল্যান্সিংয়ে আয়ের দিক থেকে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান আমাদের উপরে আছে। আমাদের যদি সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার আনার ক্ষেত্রে বিনিময় হারে বৈষম্য দূর করা যেত, তাহলে ডলার আয় অনেক বাড়ত।'

তিনি বলেন, '২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার ফ্রিল্যান্সারকে স্মার্ট কার্ড দেওয়া হয়েছে। এসব কার্ডধারী ব্যাংক ঋণ সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু এখনো কেউ এই সুবিধা পাননি। ব্যাংকের মাধ্যমে বাইরে থেকে আয়ের অর্থ আনলে ৪ শতাংশ প্রণোদনাও দেওয়ার কথা ছিল। সেটিও দেওয়া হচ্ছে না।'

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি মো. আমিন হেলালী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডলার বিনিময় হার কম হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দীর্ঘ মেয়াদে এটি চলতে থাকলে ব্যবসায়ীরাও অবৈধ পথে লেনদেনের সুযোগ খুঁজবেন। এর প্রভাব পড়বে দেশের অর্থনীতিতে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে।'

ডলারের বিনিময় হারে কোনো বৈষম্য থাকা উচিত নয় উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, 'প্রবাসীরা যে বিনিময় হার পান সেটি আরও বাড়িয়ে দিলে আমি কোনো সমস্যা দেখছি না। কারণ তারা যখন বিনিময় হার বেশি পাবেন, তখন আর হুন্ডি বা অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে টাকা পাঠাবেন না। তাদেরও দেশপ্রেম আছে। আর অবৈধভাবে কেউ টাকা উপার্জন করতে চায় না, যদি বৈধ উপায় থাকে এবং সেগুলো সহজ হয়।'

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি ডলারের বিনিময় হারে এই বৈষম্য রাখা উচিত না। ডলার ডলারই। কিন্তু কেউ ১০৭ টাকা পাবে, আবার কেউ ১০১ বা ১০২ টাকা পাবে, তা কোনোভাবেই হতে পারে না। এটি সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক। না বুঝে এটা করা হয়েছে। এখন তার খেসারত দিতে হচ্ছে অযথা। সবার জন্য অবশ্যই সমান ও ন্যায্য বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হবে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (এফইপিডি) ও সহকারী মুখপাত্র মো. সারোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করা হয়েছে। কেউ যদি বৈষম্যের শিকার হন, তাহলে আমাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এখন পর্যন্ত কেউ আলোচনা করেননি। কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করলে আমরা বিষয়টি দেখবো।'

অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘ দিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন, বাংলাদেশে ডলারের বিনিময় হার নীতি অর্থনীতির মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়নি। প্রণোদনা দেওয়ার পরেও প্রবাসীরা বিনিময় হারে অন্তত ৫-৭ টাকা কম পান। এ ছাড়া, ব্যবসায়ী, ফ্রিল্যান্সারসহ অন্যরা বিনিময় হারে ১০-১২ টাকা কম পান। যাদের সুযোগ আছে তারা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অন্য কোনো উৎস খোঁজেন। ফলে একদিক থেকে রাষ্ট্রই অন্য উৎস খুঁজতে উৎসাহিত করছেন। যার প্রভাব পড়ে দেশের রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সের উপর।

Comments