সংকটে থাকা অর্থনীতিতে আরেক ধাক্কা

কোটা সংস্কার আন্দোলন, ইন্টারনেট, কারফিউ, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি আদেশ,
কয়েকদিন পর ব্যাংক চালু হলে কাউন্টারে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে সেবা নিচ্ছেন গ্রাহক। ছবিটি গতকাল মতিঝিলের সোনালী ব্যাংক থেকে তোলা। ছবি: পলাশ খান

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতা, ইন্টারনেট বিভ্রাট ও কারফিউয়ের কারণে অর্থনীতির প্রায় সব খাত কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। যদিও গতকাল থেকে ব্যবসা ও শিল্প কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনা সংকটে থাকা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যেন আরও সংকটের দিকে ঠেলে দিল।

এ কথা সবার জানা- উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রপ্তানি কমে যাওয়া ও ডলার সংকটের কারণে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিল করছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সেই মুহূর্তে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে তৈরি হওয়া সহিংসতায় পোশাক কারখানা ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ করে দেওয়া হয় বন্দরের সব কার্যক্রম। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারফিউ জারিসহ দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার।

অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন- সহিংসতা ও ইন্টারনেট বন্ধের প্রভাব করোনা মহামারির পরিণতির চেয়ে বেশি হবে। এক হিসাব অনুযায়ী, টানা পাঁচদিনের এই অস্থিতিশীলতায় বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিদিন প্রায় এক বিলিয়ন ডলার হারিয়েছে।

যদিও এই হতাশার মধ্যে পোশাক কারখানাগুলো গতকাল থেকে পুনরায় উৎপাদন শুরু করেছে। তবে তাদের জন্য এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ হলো, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রপ্তানি চালান পাঠানো। আশার খবর হলো- গতকাল বন্দরের কার্যক্রম শুরুর পর আমদানি ও রপ্তানি কনটেইনার শিপমেন্টের গতি বেড়েছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ চালু হওয়ায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের মতে, সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় কারখানাগুলো কাঁচামাল সংকটে পড়েছে।

তিনি মনে করেন, 'সরকার যদি আলোচনার মাধ্যমে কোটা সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব দিত, তাহলে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হতো না।'

এদিকে চলমান অস্থিরতার মধ্যে তিন দিনের সাধারণ ছুটির পর গতকাল থেকে সীমিত পরিসরে ব্যাংক খুলেছে। এতে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন, রেমিট্যান্স সংগ্রহ ও ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করতে পারছে।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, চাপ সত্ত্বেও অধিকাংশ ব্যাংক সেবা দিতে পেরেছে।

তিন কার্যদিবস বন্ধ থাকার পর গতকাল সকাল ১১টায় চালু হয় পুঁজিবাজার। যদিও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমে এবং প্রায় দেড় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন লেনদেন হয়।

অন্যদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার দোকানপাট খুললেও ক্রেতাদের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। ফলে, ব্যবসায়ীরা হতাশা প্রকাশ করেন।

ঢাকা কলেজের বিপরীত পাশে অবস্থিত নূরজাহান সুপার মার্কেটের কাপড়ের দোকানের বিক্রয়কর্মী আলম শেখ বলেন, 'চলমান পরিস্থিতিতে মানুষ বাইরে বের হতে ভয় পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। এ কারণে ক্রেতার উপস্থিতি তুলনামূলক কম।'

বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত আলম শেখ মাত্র তিন হাজার টাকার পোশাক বিক্রি করতে পেরেছেন, যা তার স্বাভাবিক সময়ের আয়ের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশ কম।

এসব তথ্য অস্থায়ী হলেও তা দেশের অর্থনৈতিক স্থবিরতার চিত্র তুলে ধরে। কারণ প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্ন ব্যবসা কার্যত বন্ধ ছিল।

এই পরিস্থিতির কারণে আগামী মাসগুলোতে ভোগ্যপণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমে যেতে পারে। পাশাপাশি রপ্তানি আদেশ হারানোর ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। তাই অনেক কোম্পানি কর্মীদের সময়মতো বেতন দিতে হিমশিম খাবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, গত কয়েকদিনে প্রতিদিন প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট ক্ষতি। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে।'

তিনি বলেন, 'সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্ন ঘটলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, যা ইতোমধ্যে উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।'

তার ভবিষ্যদ্বাণীর পেছনে একটি শক্ত ভিত্তি রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নয় দশমিক সাত তিন শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সরকারের সাত দশমিক পাঁচ শতাংশের চেয়ে বেশি।

আহসান এইচ মনসুর সতর্ক করে বলেন, সাম্প্রতিক এই সংকটের কারণে বাংলাদেশ রপ্তানি আদেশ হারাতে পারে।

আরেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এই সংকটকে দেশের দ্বৈত বিপদ হিসেবে অভিহিত করেছেন। যথাক্রমে- বাস্তব জীবনের লকডাউন এবং ভার্চুয়াল লকডাউন।

তিনি বলেন, 'এর প্রভাব করোনা মহামারির চেয়েও মারাত্মক হবে। কারণ মহামারিতে মানুষের ব্যবসা সচল ছিল। এছাড়া মহামারির সময় অনলাইনে পেমেন্ট করা যেত। সেখানে চলতি সপ্তাহে ইন্টারনেট বিভ্রাটের কারণে সবকিছু বন্ধ ছিল।'

ডেইলি স্টারের হিসাব অনুযায়ী, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে তৈরি হওয়া অস্থিরতায় অন্তত ১৫৪ জন নিহত হয়েছেন। এই হিসাব শুধু হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। তাই মৃত্যুর সংখ্যা আরও

বেশি হতে পারে। কারণ দ্য ডেইলি স্টার সব হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি, এমন অনেক হাসপাতালে গুরুতর আহতদের চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও অনেকের বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে তাদের প্রিয়জনের মরদেহ সংগ্রহ করেছে বলে জানা গেছে। দ্য ডেইলি স্টার তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারেনি। আবার অনেক হাসপাতাল মৃত্যুর তথ্য সংরক্ষণ করেনি, তারা মরদেহ আত্মীয়দের নিয়ে যেতে বলেছিল।

জাহিদ হোসেন বলেন, এসব কিছু বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা কমাবে এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে।

তিনি বলেন, 'ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী ছিল। এই ধাক্কা কতটা প্রবল হবে এবং কতদিন তার প্রভাব থাকবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। যদিও আমরা প্রাণহানির ক্ষতির কোনো সমীকরণ হয় না।'

Comments

The Daily Star  | English

In coffins, from faraway lands

Kazi Salauddin, a 44-year-old man from Cumilla, migrated to Saudi Arabia in October 2022, hoping to secure a bright future for his family. But barely a year later, Salauddin, the father of two daughters and a son, died suddenly.

5h ago