চট্টগ্রাম

প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণ হয়েছে ৩.৬ শতাংশ

চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় একটি ছোট দোকানে পোশাকের সূক্ষ্ম নকশার কাজ করছেন কারিগররা। এ ধরনের অনেক ছোট-বড় উদ্যোক্তারা সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের অধীনে ঋণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন। ছবি: রাজীব রায়হান/স্টার

করোনা মহামারি চলাকালে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র, মাঝারি ও কুটির শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে প্রণোদনা ঋণ সুবিধা চালু করেছিল সরকার। অথচ চট্টগ্রাম জেলার জন্য বরাদ্দ প্রণোদনা লক্ষ্যমাত্রার ৪ শতাংশেরও কম বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো। 

প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে অনেকেই গত ২ বছরে একাধিকবার আবেদনও করেও কোনো ধরণের ঋণ সহায়তা পাননি না বলে অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ী। 

জেলার কটেজ, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) ঋণ বিতরণ মনিটরিং কমিটির তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৫টি ব্যাংকের প্রণোদনা ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ২৯ কোটি ৯৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। 

এই ১৫টি ব্যাংকের সার্বিক ঋণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৩৪ কোটি ৬৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ, লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। 

শুধু চট্টগ্রাম জেলার ১৯২ জন ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা এই ঋণ সহায়তা পেয়েছে। ১৫ ব্যাংকের মধ্যে সোনালী ব্যাংক ছাড়া সবগুলোই বেসরকারি খাতের। 

২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তথ্য হালনাগাদ না হওয়ায় এ সময়ে কতজন ঋণ সহায়তা পেয়েছেন, তা এখনো জানা যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন এ সময়ে ঋণ সহায়তা আরও কমেছে। 

চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে ঋণ বিতরণের হার কম থাকায় এ বছর ঋণ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রান্তিকে ২২টি ব্যাংক ১ হাজার ৫৫২ জন উদ্যোক্তাকে মোট ৬৪৭ কোটি ১৫ লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছিল। 

এই খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালে সংকটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সহজে ঋণ দিতে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের তৃতীয় ধাপের ঋণ বিতরণ চলছে।প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে ঋণ কার্যক্রম কিছুটা গতিশীল থাকলেও, তৃতীয় পর্যায়ে এসে ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কিছুটা ধীরগতিতে এগুচ্ছে। প্রথম দুই ধাপে ঋণের সুদহার ৪ শতাংশ থাকলেও তৃতীয় কিস্তিতে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ করা হয়েছে। 

চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার প্রতিষ্ঠান মেসার্স এস এ বোরকা হাউসের সত্ত্বাধিকারী আরিফ উল্লাহ চৌধুরী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনাকালে দীর্ঘদিন বন্ধের কারণে ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছিল। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণার পর বিভিন্ন ব্যাংকে যোগাযোগ করা হলেও প্রণোদনা ঋণ দিতে তারা গড়িমসি করে। ফলে ব্যবসায় নতুন বিনিয়োগে যেতে পারিনি।' 

একই অভিযোগ চট্টগ্রামের কমার্স কলেজ রোডের মেসার্স খাজা গরিবে নেওয়াজ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সত্ত্বাধিকারী মো. রহিম খানের। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'করোনাকালে বড় অঙ্কের লোকসানের সম্মুখীন হই। সরকার ঘোষিত প্রণোদনা ঋণ পেতে গত এক বছর ধরে বিভিন্ন ব্যাংকে আবেদন করেও কোনো ঋণ পাইনি।' 

একই অভিযোগ করেছেন চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন বিসিকের নিবন্ধিত অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের। স্বল্প সুদের প্রণোদনা ঋণ না পেয়ে তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো যাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো এবং যেসব ব্যবসায়ী স্বাবলম্বী তাদের স্বল্প সুদের ঋণ দিলেও, প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।  

চট্টগ্রামের আরেকটি মাঝারি উদ্যোক্তা সন্দ্বীপ উপজেলার মেসার্স অ্যাকটিভ চিকস অ্যান্ড ফিডের সত্ত্বাধিকারী মো. আমিন মাসুম বলেন, 'করোনার প্রভাব ও দেশে পশু খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ব্যবসার পুঁজি অনেক কমে গেছে। একইভাবে ছোট ছোট পোল্ট্রি খামারিদেরও পুঁজি সংকট রয়েছে। তারা বাকিতে পশুখাদ্য কিনতে চাইলেও আমার পুঁজি কমে যাওয়ায় তাদের সহায়তা করতে পারছি না।' 

যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম জেলা সিএমএসএমই ঋণ বিতরণ মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক নিজাম উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের প্রতিশ্রুত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ বিতরণের তৃতীয় কিস্তি চলছে। পূর্বের দুই ধাপের তুলনায় তৃতীয় ধাপে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম কিছুটা ধীর।'

তিনি বলেন, 'প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা যেন প্রণোদনা ঋণ পায়, সেজন্য ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং কার্যক্রম ছাড়াও ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করা হচ্ছে। এরপরও ঋণের প্রবাহ কম হচ্ছে।'

'আমরা ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে চিঠির মাধ্যমে প্রণোদনা ঋণ বিতরণের তথ্য সরবরাহ ছাড়াও নিয়মিত বৈঠকের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছি,' যোগ করেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো প্রতিশ্রুত ঋণ বিতরণে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে আছে সরকারি ব্যাংক। সর্বশেষ অর্থবছরে সরকারি ব্যাংকের ঋণ বিতরণের হার মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। 

এর মধ্যে, সোনালী ব্যাংক ৬০ জনকে ঋণ দিয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এছাড়া দ্য সিটি ব্যাংক ১২ কোটি ৮১ লাখ টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা, পূবালী ব্যাংক ২ কোটি ২০ লাখ টাকা, এবি ব্যাংক ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা, প্রাইম ব্যাংক ২ কোটি ৪২ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, ন্যাশনাল ব্যাংক ১৩ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ১২ লাখ টাকা, এক্সিম ব্যাংক ২৯ লাখ টাকা প্রদান করেছে। 

এ প্রসঙ্গে চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনেক ব্যাংক প্রণোদনা ঋণ বিতরণে গড়িমসি করছে। কেউ অভিযোগ করলে চেম্বারের পক্ষ থেকে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। সরকারি পরিপত্র অনুযায়ী ব্যাংকগুলোতে ঋণ প্রদানে সহযোগিতার জন্য বলাও হয়েছে।'

তিনি বলেন, 'সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোর উচিত প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা ঋণ বিতরণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহযোগিতার মাধ্যমে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।'  

তবে, ঋণ বিতরণে ধীরগতি প্রসঙ্গে একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি। 

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা বলেন, 'ঋণ প্রবাহ প্রথম দুই ধাপে স্বাভাবিক থাকলেও তৃতীয় ধাপে তা কমে গেছে। সিঙ্গেল ডিজিটে (সুদহার ১০ শতাংশের নিচে) ঋণ পাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের আগ্রহ থাকলেও তা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সন্দিহান। ফলে অনেক যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেওয়া হচ্ছে।'

Comments