মূল্যস্ফীতির চাপ, করমুক্ত আয়সীমা কি বাড়ানো উচিত

মোহাম্মদ ফিরোজ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ উৎপাদনকারী একটি কোম্পানিতে কাজ করেন। মাসে তার আয় ২৯ হাজার টাকা।

পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে থাকতেন রাজধানীর মিরপুরের একটি ছোট ফ্ল্যাটে। তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় খরচ কুলাতে না পেরে গতমাসে বাধ্য হয়েছেন ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে টিনশেডের ঘরে উঠতে।

পরিবারে ছোট দুই সন্তান, স্ত্রী আর মা আছেন। বড় বাসা নেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় একটা ঘরকেই মাঝখানে বোর্ড দিয়ে দুই রুম করেছেন। দুই সন্তানকে নিয়ে ঘরে থাকেন ফিরোজ দম্পতি, আরেক ঘরে মা।

'আমার যা আয় তাই দিয়ে দুই সন্তানের স্কুলের খরচ, মায়ের ওষুধ কেনা, বাসা ভাড়া, খাবার খরচের জন্য যথেষ্ট নয়। আমার আর কোনো উপায়ও নেই টাকা রোজগারের,' বলছিলেন ফিরোজ।

কেবল ফিরোজ নয়, ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতনের এমন লাখ লাখ নিম্ন আয়ের মানুষ এবং যাদের বাড়তি আয়ের সুযোগ নেই গত এক বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে মরার উপর খারার ঘাঁয়ের মতো মাসিক আয় ২৫ হাজার টাকা ছাড়ালেই করের আওতায় আসতে হয়। কারণ বাৎসরিক ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত কর দিতে হয় না।

নিম্ন আয় এবং নির্দিষ্ট বেতনভোগীসহ বিশ্লেষকেরাও বলছেন, ২৫ হজার টাকা আয়ের ওপর করের বোঝা তাদের জন্য অনেক ভারী।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, নিয়োগকর্তারা প্রতি মাসে কর্মচারীর বেতন থেকে ট্যাক্স কেটে নেয় এবং তা সরকারি কোষাগারে জমা করে।

'এত কম বেতনের ওপর কীভাবে আয়কর দিতে বলে সরকার', প্রশ্ন ফিরোজের।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, পণ্যের দাম, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে বাড়তি চাপের মধ্যে করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা হওয়া উচিত।

বেসরকারি এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা শহরে বসবাসকারী ৪ সদস্যের একটি পরিবারের জীবনযাপনের জন্য মাসে অন্তত ২৩ হাজার ৬৭৬ টাকা প্রয়োজন।

ব্যক্তিগত আয়করের দ্বিতীয় স্ল্যাব যা অতিরিক্ত ১ লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ, সীমিত আয়ের মানুষের জন্য সেটি ৩ লাখ টাকায় উন্নীত করা উচিত বলে মনে করেন তৌফিকুল ইসলাম।

সরকার ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকাতেই রেখেছে যদিও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।

একই সময়ে, সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে এটি অপেক্ষাকৃত কম আয়ের মানুষের জন্য সুফল আনবে না।

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, 'বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার অনেক বেশি। তাই মাসিক ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতনে পরিবার চালানো কঠিন। তাই করমুক্ত আয়ের সীমা পুনর্বিন্যাস করা উচিত।

'যদি এই সীমা বাড়ানো হয়, তবে সরকারের রাজস্ব উৎপাদনে এর কোনো বড় প্রভাব পড়বে না কারণ করদাতাদের এই গোষ্ঠীটির কাছ থেকে খুব কম কর আসে,' বলেন তিনি।

সঠিকভাবে আয় দেখাচ্ছেন না এমন ব্যক্তিদের কর ব্যবস্থায় এনে করের আওতা সম্প্রসারণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রতি আহ্বান জানান এই অর্থনীতিবিদ।

বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ফেব্রুয়ারিতে বেড়ে হয়েছে ৮.৭৮ শতাংশ, যা গত পাঁচ মাসের নিম্নমুখী যে প্রবণতা ছিল সেটি ভেঙে দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের উচ্চ মূল্যে গত আগস্টে এটি ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছায়।

জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে নাগরিকদের রক্ষায় অনেক দেশ বিভিন্ন ধরনের কর সুবিধা দিচ্ছে।

যেমন ভারতে আগামী ১ এপ্রিল থেকে শুরু হতে অর্থবছরে কর ছাড়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লাখ টাকা করা হয়েছে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর অবশ্য বলছেন, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে করমুক্ত আয়ের মাত্রা বেশি। 

'সুতরাং, আমি করমুক্ত আয়ের স্তর বাড়ানোকে সমর্থন করি না। পরিবর্তে, কম আয় করলেও জনগণকে সরাসরি কর দিতে হবে। কর দেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে,' বলেন তিনি।

তিনি বলেন, করদাতার অর্থের অপব্যবহার জনগণকে কর দিতে নিরুৎসাহিত করছে, তাই সরকারের উচিত অর্থের মূল্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

মানুষ যখন দেখে যে তাদের কষ্টার্জিত অর্থ যা কর দিয়েছে তার অপব্যবহার করা হচ্ছে এবং তারা মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং অন্যান্য পরিষেবা পায় না, তখন তারা কর দিতে নিরুৎসাহিত বোধ করে, বলেন আহসান এইচ মনসুর।

'করদাতার টাকা ব্যবহারে সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।'

এনবিআরের কর নীতির সদস্য সামস উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমরা এখন স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলছি এবং তারা করমুক্ত আয়ের স্তর বাড়ানোর সুপারিশ করছে।'

বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এনবিআর শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবে বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

US cuts tariffs on Bangladesh to 20% after talks

The deal for Dhaka was secured just hours before a midnight deadline set by President Donald Trump

2h ago