বাজেট ২০২৩-২৪: মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ
দেশের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করাকে মূল লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে আগামী ১ জুন পরবর্তী অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা ও উচ্চতর জিপিডি প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা।
এবারের বাজেট 'সম্প্রসারণমূলক বা সংকোচনমূলক' হবে না বলে উল্লেখ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান ৫ বছরের মেয়াদের শেষ বাজেট হবে এবার। এমন এক সময়ে এসে এই বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে যখন খাদ্য থেকে জ্বালানি ও পরিবহন ভাড়া থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল পর্যন্ত প্রায় সব কিছুরই উচ্চমূল্যের সঙ্গে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
সরকার চায় আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি যাতে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছায় এবং মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রভিশনাল হিসাব বলছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপি বেড়েছে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতির হার এপ্রিল পর্যন্ত ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
আগামী বাজেটের আকার বর্তমান বাজেটের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বড় হবে।
বাজেটটি ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকার প্রাক্কলিত জিডিপির ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ছিল ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। 'এর মাধ্যমেই বোঝা যায় যে আগামী বাজেটটি উচ্চাভিলাষী নয়', বলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে 'দেড় দশকের উন্নয়নের পর স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রগতি' শীর্ষক বাজেট বক্তৃতা দেবেন।
বাজেটে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মতো খাতে বরাদ্দের বড় কোনো পরিবর্তন হবে না।
ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি এবং সুদ পরিশোধের জন্য ১ লাখ ২ হাজার কোটির বেশি করা হবে। চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধের জন্য ছিল ৮০ হাজার কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের উচ্চমূল্য এবং টাকার মান কমায় এই ২ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা বলেন, কিছু ভর্তুকির বোঝা কমাতে বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানো হয়েছে। তবে বকেয়া পরিশোধ করতে ভর্তুকির জন্য সরকারের এখনো আরও অর্থ প্রয়োজন।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সরকার বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আগামী অর্থবছরে কঠোরতা অবলম্বন অব্যাহত রাখবে।
বাজেটের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়ানো হবে না বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা
আইএমএফের ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির একটি শর্ত মাথায় রেখে সরকার ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি।
আইএমএফের শর্ত অনুসারে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এমনভাবে রাজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে '২০২৩-২৪ অর্থবছরে এর আগের অর্থবছরের চেয়ে জিডিপির আরও অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব লাভ করতে পারে'।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মোট কর-রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রকৃত রাজস্ব ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ।
আগামী অর্থবছরের প্রাক্কলিত জিডিপি ৫০ লাখ ৬ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা এবং এর দশমিক ৫ শতাংশ হলো ২৫ হাজার ৩৪ কোটি টাকা।
'রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে করদাতার সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে সারা দেশে বেসরকারি এজেন্ট নিয়োগসহ বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে', বলেন মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা।
এজেন্টরা সরাসরি কর আদায় করবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, এজেন্টরা মানুষের কাছে গিয়ে তাদেরকে করের আওতায় আসতে রাজি করাবে এবং তাদের কর ফাইল খুলতে ও রিটার্ন জমা দিতে সাহায্য করবে।
যাদের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (টিআইএন) আছে এবং যাদের আয় করযোগ্য আয়সীমার নিচে, তাদেরকেও রিটার্ন জমা দিতে হবে এবং ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দিতে হবে।
করভুক্ত আয়সীমা বর্তমান ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা করা হতে পারে। করভুক্ত আয়ের ওপর ন্যূনতম কর আগের মতো ৫ হাজার টাকাই থাকছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, করযোগ্য আয় নেই এমন ব্যক্তিদের জন্য টিআইএন বাতিল করার মতো বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে, যাতে তাদের কর দিতে না হয়।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৮৮ লাখ মানুষের টিআইএন আছে। তবে তাদের মধ্যে কর রিটার্ন জমা দিয়েছে কেবল ৩০ লাখ মানুষ। যারা রিটার্ন জমা দেন, তাদের অনেকেই কর প্রদান করেন না। কারণ তাদের আয় করযোগ্য নয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আরেক কর্মকর্তা জানান, তারা রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানোর জন্য আরও ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) স্থাপন করবেন।
আগামী ৩ বছরে ৩ লাখ ইএফডি স্থাপন করা হবে। বর্তমানে ৯ হাজার ইএফডি চালু আছে।
কর অব্যাহতি কমানোর জন্য আইএমএফের সুপারিশের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, আগামী বাজেটে পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হবে।
কীভাবে রাজস্ব সংগ্রহ উন্নত করা যায়, তা দেখতে জুলাইয়ে আইএমএফের একটি দল ঢাকায় আসবে।
বাজেট ঘাটতি
আগামী বাজেটে সার্বিক ঘাটতি হবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
আইএমএফ শর্ত অনুযায়ী বাজেটের প্রাথমিক ঘাটতি জিডিপির ৩ শতাংশের মধ্যে থাকতে হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রকৃতপক্ষে ঘাটতি আইএমএফ-নির্ধারিত সীমার কাছাকাছিই আছে। কারণ সামগ্রিক ঘাটতি থেকে সুদ প্রদান ও বৈদেশিক অনুদান বাদ দিয়ে প্রাথমিক ঘাটতি ধরা হয়।
পরবর্তী অর্থবছরের প্রাথমিক ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা জিডিপির ৩ দশমিক ১ শতাংশ।
Comments