সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ অব্যাহত থাকবে

বিদায়ী অর্থবছরের মতো ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও দেশের সাধারণ মানুষের ওপর উচ্চমূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে।
মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, অর্থবছর, আইএমএফ,
বাংলাদেশের একটি বাজারের সাধারণ দৃশ্য। স্টার ফাইল ফটো

বিদায়ী অর্থবছরের মতো ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও দেশের সাধারণ মানুষের ওপর উচ্চমূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। যদিও বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশের উচ্চমূল্যস্ফীতির হার কমেছে। কিন্তু, বাংলাদেশে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং দেশে মূল্যস্ফীতি কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০-২৪ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৬ শতাংশ। তবে, পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির হার মে মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৯৪ শতাংশে, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৭.৪২ শতাংশ।

গত মাসে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৮৪ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের জুনের জন্য সরকারের নির্ধারিত সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৭.৫০ শতাংশকে ছাড়িয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই মনে করছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন খুবই কঠিন হতে পারে।

রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, 'আন্তর্জাতিক বাজারের সাম্প্রতিক দর পতন সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ মূল্য সমন্বয়ে জটিলতা ও দেশীয় মুদ্রার দরপতনের কারণে দেশের মূল্যস্ফীতির নিন্মমুখী প্রবণতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ফলে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে মূল্যস্ফীতির এই অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকতে পারে। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির যে চাপ দেখা দিয়েছে, তা ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।'

কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতির বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বাজার সিন্ডিকেটের পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশের অভাবের কথা স্বীকার করেছে। অন্তত এক দশকের মধ্যে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে আছে গত ৩ বছর ধরে ৯ শতাংশ সুদের হারের সীমা।

আশাবাদী উদ্যোগ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার পরিবর্তন করে গত এক বছরে ষষ্ঠবারের মতো সুদের হার বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, পলিসি রেট বৃদ্ধি এবং এই সীমা প্রত্যাহারের ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ঋণের খরচ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। যা পরবর্তীতে পুরো অর্থনীতির সুদের হারকে প্রভাবিত করবে। এই সমন্বয় ব্যবসা ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিনিয়োগ এবং খরচের তহবিল সংগ্রহ আরও ব্যয়বহুল করবে।

এই পরিবর্তন অতিরিক্ত আর্থিক সম্প্রসারণ কমাতে চায়, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।

আরেকটি বড় অগ্রগতি আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি সমন্বিত ও বাজার-চালিত একক বিনিময় হার চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি একটি একক বিনিময় হার বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে রিজার্ভ পরিস্থিতিতে কিছুটা উন্নতি হতে পারে।

রিজার্ভ কমার জন্য রপ্তানিকারক, রেমিট্যান্স ও আমদানিকারকদের জন্য পৃথক হারসহ একাধিক বিনিময় হার ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়েছে।

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি বলেছে, বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধ বিনিময় হারের মধ্যে এক শতাংশ বিচ্যুতির ফলে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ রেমিট্যান্স বৈধ মাধ্যম থেকে অবৈধ মাধ্যমে চলে যায়।

বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, আমদানি ও রেমিট্যান্সের বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধান থাকায় আমদানিকারদের ব্যাংক থেকে আরও মার্কিন ডলার কিনতে ও মুনাফা রেমিট্যান্স হিসাবে ফেরত পাঠাতে ওভার-ইনভয়েস আমদানির প্রণোদনা আছে। এই হারের মধ্যস্থতার ফলে ব্যাংকগুলোর মার্কিন ডলারের তারল্য আরও কমে যায় এবং সমান্তরাল বিনিময় হার বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহকে নিরুৎসাহিত করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। এটি গত বছরের জুনের ৪১.৪৪ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক কম।

গ্লোবাল রেটিং এজেন্সি মুডিস ইতোমধ্যে জানিয়েছে, আগামী ২-৩ বছর মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকবে।

গত এক বছরে রিজার্ভের ২৯ শতাংশ পতন, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি আমদানি ও বৈশ্বিক পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকার বাইরে থেকে ক্রয় সীমাবদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। যা সরবরাহ ব্যবস্থা কঠিন করেছে এবং স্থানীয় বাজারে দাম বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে।

রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি না পাওয়া পর্যন্ত সরকারকে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হতে পারে। যার অর্থ হলো কাঁচামাল ও সরঞ্জাম আমদানির জন্য লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খুলতে ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংগ্রাম করতে হবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার প্রয়োজনীয় পর্যায়ে যেতে অনুমতি দিলেই মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রায় নেমে আসবে। কেউ জানে না সুদের হার কত বাড়াতে হতে পারে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।'

তিনি বলেন, 'মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, এখানে শক্তিশালী ওষুধের ডোজ প্রয়োগ করতে হবে, কারণ রোগটি গুরুতর। কিন্তু, সুদের হার বর্তমান স্তর থেকে মাত্র ১-২ শতাংশ বৃদ্ধি করতে দিলে অর্থ সরবরাহ কঠিন হবে না।'

আইএমএফের সাবেক এই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, ২০২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে সরকারি ঋণের ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

'সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উচ্চতর ঋণ মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়াবে। তারপর এটি সংকোচনমূলক আর্থিক নীতি থাকবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ ন্যূনতম হতে হবে,' বলেন তিনি।

নতুন পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রাথমিকভাবে ৬ মাসের স্বল্পমেয়াদী ট্রেজারি বিলের সুদের হারের ভিত্তিতে গণনা করা ওয়েটেড এভারেজ রেটের ভিত্তিতে মাসিক রেফারেন্স রেট নির্ধারণ করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক টি-বিল এবং টি-বন্ডের সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারি সিকিউরিটিজের নিলামের সময় কম রেট দেয়, তাই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেগুলো কেনার সুযোগ পায় না।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'মনে হচ্ছে সুদের হার বাজারভিত্তিক হবে না। যদি তাই হয়, তবে এটি অর্থ সরবরাহকে সংকুচিত করতে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে না।'

প্রয়োজনে মূল্যস্ফীতির ওপর সমন্বয় সেল গঠনে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি, যেন মনিটরিং বাড়ানো যায় ও বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি দূর করা যায়।

Comments