সংকটে অর্থনীতি, বিনিয়োগেও নেই ভালো খবর
দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলো চাপে আছে, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে বিনিয়োগ প্রবাহেও কোনো ভালো খবর নেই। কারণ বিনিয়োগকারীরা বর্তমানে নতুন ব্যবসা বা প্রকল্প শুরু কিংবা বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণ করছেন না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনিয়োগ না বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ- চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি, মার্কিন ডলার সংকটে আমদানি অসুবিধা এবং ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, যা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এটি চাকরিপ্রার্থীদের জন্য একটি নেতিবাচক দিক, কারণ বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। একইসঙ্গে এটি অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের অভাবের একটি প্রতিফলন, যা চলতি অর্থবছরে সরকারের ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হতে পারে।
গত সপ্তাহে বিশ্বব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস সংশোধন করে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। কারণ, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও বহিস্থ চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুরো বছরজুড়ে চাপে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা বলেন, যেকোনো সাধারণ নির্বাচনের আগে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রবাহ সাধারণত কম থাকে। কিন্তু, এ বছরের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধনের বিষয়টি ধরা যাক, যা গত অর্থবছরে কমেছে।
গত অর্থবছরের মে-জুলাই এই তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ প্রস্তাব কমেছে ৩৯ শতাংশ।
বিডার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন খাতে ৯ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য খোলা ঋণপত্রের (এলসি) তীব্র পতন এবং এ বছরও নিম্নমুখী প্রবণতা অব্যাহত থাকায় বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহের অভাব বেশ ভালোভাবেই দৃশ্যমান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার হার আগের বছরের চেয়ে ২২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ঋণপত্র নিষ্পত্তি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ শতাংশ কমে ৪৯০ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি পতন হয়েছে চামড়া শিল্পে, এরপর আছে পাট ও প্যাকিং খাত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ওষুধ শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ৬৫ শতাংশ। একইভাবে জুলাই-আগস্ট সময়ে পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ খাতের টেক্সটাইল মেশিনারিজের জন্য ঋণপত্র খোলার হার ৫৫ শতাংশ কমেছে।
এছাড়া, অন্যান্য শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির জন্যও ঋণপত্র খোলার হার কমেছে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণের মন্থর প্রবৃদ্ধির কারণে ঋণের চাহিদাও কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্টে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, 'আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভব্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক।'
তিনি জানান, সামষ্টিক অর্থনৈতিক দুর্বলতা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, ব্যাংক সুদের উচ্চ হার এবং আমদানি বিধিনিষেধ বিনিয়োগ আগ্রহে প্রভাব ফেলেছে।
'যদিও সব বিনিয়োগ প্রস্তাব পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয় না, কিন্তু এটি বিনিয়োগ পরিস্থিতি ও বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের একটি সূচক,' বলেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'এটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্যও প্রযোজ্য।'
তবে, বিনিয়োগ কমে যাওয়ার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল জানান, তিনি একটি স্টিল মিল, গ্লাস ফ্যাক্টরি, পেপার মিল, কেমিক্যাল প্ল্যান্ট সম্প্রসারণসহ পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। কিন্তু কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি ও মার্কিন ডলারের কারণে প্রকল্প ব্যয় বাড়লেও এখন প্রকল্পগুলো থেকে পেছানোর কোনো সুযোগ নেই।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম বলেন, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার মূল কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা।
তিনি জানান, ওই যুদ্ধের চেইন রিঅ্যাকশন হিসেবে টাকার ওপর চাপ পড়ে, যার ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে। তাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমদানি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
তিনি মন্তব্য করেন, এর পাশাপাশি জ্বালানি উৎপাদনে কাঁচামালের স্বল্পমেয়াদী স্বল্পতা এবং মুডিজ, ফিচ এবং এসঅ্যান্ডপি রেটিং কমানোয় সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
তিনি বলেন, 'তবে জ্বালানি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং ২০২৪ সালের জানুয়ারির পর রিজার্ভ পরিস্থিতি আরও ভালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সুতরাং ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে একটি পরিবর্তন সম্ভব হতে পারে।'
ডিসিসিআই সভাপতি সমীর সাত্তার বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট বর্তমান ভূ-অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে ভাঙন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি শুরু হয়েছে। এই বাহ্যিক কারণে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমেছে।
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, এই বিনিয়োগ প্রবণতা অন্তর্বর্তীকালীন এবং ভূ-অর্থনৈতিক সংকট শেষ হলেই আমাদের বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগ ইতিবাচকভাবে বাড়বে।'
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের সভাপতি হুমায়ুন রশীদ বলেন, সরকার গত এক দশকে বড় ধরনের অবকাঠামো উন্নয়ন করেছে। তাছাড়া গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল, যা বিনিয়োগের জন্য একটি ইতিবাচক দিক।
'তবে, ব্যবসা করার সুবিধার উন্নতি ও শুল্ক পদ্ধতি সহজ করাসহ বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতির ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন আছে,' যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'সরকার যদি সুশাসনের বিষয়গুলো সমাধান না করে, তাহলে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ আরও কমে যাবে।'
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা, বিনিয়োগ সংক্রান্ত নীতিমালা ও শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের উন্নতি হবে না। দেশে চাহিদার তুলনায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ খুবই কম।
তিনি জানান, বর্তমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বিনিয়োগের মন্দা পরিস্থিতির জন্যও দায়ী। এগুলোর সমাধান না হলে বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগ বা বিদ্যমান ব্যবসা সম্প্রসারণ করবে না।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত, তাই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, 'নির্বাচনের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।'
Comments