৫ বছরে স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে ৮ লাখ

জরিপ বলছে, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীর হার ২০১৭ সালের ১১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

প্রতি সপ্তাহে রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে খুবই সাধারণ একটি দৃশ্য দেখতে পান ঢাকার বাসিন্দারা। আর তা হলো- দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা তরুণরা হয় ভিতরে ঢোকার জন্য প্রবেশপথে অপেক্ষা করছেন, অথবা নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন।

তেমনই একজন মাসুদুর রহমান। তিনি চার বছর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন।

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা সিরাজগঞ্জের গ্রামের বাড়ি থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কয়েক বছর ধরে ঢাকাতে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে আসছেন তিনি।

মাসুদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাকরির বাজার খুবই প্রতিযোগিতামূলক। মাঝে মাঝে আমাকে একটি পদের বিপরীতে প্রায় ১ হাজার ৫০০ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়।'

দেশে স্নাতক শেষ করা লাখ লাখ তরুণের মধ্যে ২৭ বছর বয়সী মাসুদুর রহমান একজন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ৮ লাখ স্নাতক ডিগ্রিধারী বর্তমানে চাকরিতে নেই।

বুধবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ এ (এলএফএস) বেকার স্নাতকের সংখ্যা বৃদ্ধির এই ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে।

জরিপ বলছে, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীর হার ২০১৭ অর্থবছরের ১১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, এই পাঁচ বছরে বেকার স্নাতকের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, যা ২০১৭ অর্থবছরে প্রায় ৪ লাখ ছিল। ফলে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ তৈরি করছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অর্থনীতিবিদ ও জেনেভায় ইন্টারন্যাশনাল লেবার অফিসের কর্মসংস্থান বিভাগের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম বলেন, অনেক উন্নয়নশীল দেশের গড় হারের চেয়ে শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি।

'বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়,' বলেন তিনি।

তবে, ২০১৭ অর্থবছরের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করা হলে ২০২২ সালের পরিসংখ্যানে একটি অন্যরকম তথ্য উঠে আসে।

২০১৭ অর্থবছরে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের শিক্ষাগ্রহণকারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি ছিল। বিপরীতে ২০২২ সালে স্নাতক ও সমমানের শিক্ষাগ্রহণকারীদের মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি ছিল।

তিনি বলেন, 'এটি শ্রমবাজারের দৃষ্টিকোণ থেকে উচ্চশিক্ষার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শিক্ষাব্যবস্থা কেমন গ্রাজুয়েট তৈরি করছে, যাদের যোগ্যতা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো কাজে আসে না?'

স্নাতক ডিগ্রিধারী বেকারের এই পরিসংখ্যান তৃতীয় স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় আরও বিনিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে।

তিনি বলেন, 'দেশের কি এ ধরনের শিক্ষার উপযোগিতা ও কার্যকারিতার দিকে মনোযোগ না দিয়ে আরও বিনিয়োগের দিকে যাওয়া উচিত?'

২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা গেছে, গত বছর সামগ্রিক শ্রমশক্তি বেড়েছে ৭ কোটি ৩০ লাখ, গত পাঁচ বছরে বেড়েছে ৯৫ লাখ।

জরিপ অনুযায়ী- উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণকারী মানুষের মধ্যে বেকারত্ব কমায় বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ থেকে কমে ২৫ দশমিক ৮ লাখে দাঁড়িয়েছে।

২০২২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ কারীদের মধ্যে ছিল ২ দশমিক ৮২ শতাংশ।

যারা কোনো ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করেননি তাদের মধ্যেও বেকারত্বের হার কমেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, নিয়োগদাতা ও চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে প্রত্যাশার বিরাট ঘাটতি আছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা দিতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তাই নিয়োগকারীরা দক্ষ কর্মী পাচ্ছেন না। অন্যদিকে প্রত্যাশার সঙ্গে না মেলায় বিপুল সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি।'

অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাতেও গুণগত মানের অভাব দেখছেন।

তিনি বলেন, 'এই ঘাটতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে গেছে এবং সবাই এটি কাটিয়ে উঠতে পারে না।'

এই অর্থনীতিবিদ উচ্চমাধ্যমিক পাস করা সব শিক্ষার্থীকে স্নাতকে ভর্তি করার ধারণাটিকে সমর্থন করেন না।

তিনি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, 'শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষায় যেতে না চাইলে বেকার গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা কমবে না।'

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলছেন, গ্রাজুয়েট পর্যায়ে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি অপ্রত্যাশিত নয়।

তিনি জানান, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গ্রাজুয়েট পর্যায়ে বেকারত্বের হার বাড়তে পারে।

জরিপে ইতিবাচক দিকও আছে। যেমন- গ্রামীণ অঞ্চলে নারী বেকারত্বের হার ২০১৭ অর্থবছরের ২৬ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে।

'এটি ইঙ্গিত দেয় যে, এনজিও এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য গ্রামীণ নারীরা কর্মক্ষেত্রে অংশ নিয়েছেন,' বলেন বিনায়ক সেন।

Comments