বাংলাদেশ কি অব্যবহৃত জনশক্তি কাজে লাগাতে পারবে?

‘বাংলাদেশ এখনো তার শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে জনশক্তিকে উত্পাদনশীল করে তোলা যায়নি।’
কাজের খোঁজে মানুষ
লালমনিরহাটে কাজের অপেক্ষায় মানুষ। ছবি: এস দিলীপ রায়/স্টার ফাইল ফটো

ফরহাদ হোসেন সিরাজগঞ্জের আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ডিগ্রি কলেজ থেকে ২০১৯ সালে ম্যানেজমেন্টে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর থেকেই স্থায়ী চাকরি খুঁজছেন।

যদিও টিউশনি করে নিজের খরচ চালাচ্ছেন, তবুও নিজেকে বেকার বলেই মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুসারে ফরহাদ বেকার নন। তাকে চাকরিজীবী ও তার মেধা-শ্রমকে পুরোপুরি কাজে লাগানো হয়নি বলে মনে করা হয়।

সংজ্ঞা অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি আগের সপ্তাহে কোনো কাজ না করেন, এমনকি এক ঘণ্টার জন্যও কাজ না করেন বা কাজে অনুপস্থিত থাকেন তবে তাকে বেকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করা রায়হান উদ্দিন এমন আরেক উদাহরণ। তিনি বন্দর নগরীতে একটি অনলাইন পোর্টালে দিনে চার ঘণ্টা ও সপ্তাহে পাঁচ দিন খণ্ডকালীন কাজ করেন।

২০২২ সালে দেশে ফরহাদ হোসেন ও রায়হান উদ্দীনের মতো প্রায় ৬৮ লাখ মানুষের মেধা-শ্রম পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি।

শ্রমবাজারে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সামঞ্জস্যের অভাব থাকলে যে মানুষ তার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পান না বা তিনি যে কাজ করছেন তাতে সন্তুষ্ট নন এমন কাউকে 'মেধা-শ্রম পুরোপুরি কাজে না লাগানো' মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়।

২০২২ সালে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ৪১ লাখ মানুষের মেধা-শ্রম পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি। জরিপ অনুসারে, তাদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় থাকেন।

গ্রামীণ ও শহুরে এলাকায় ৪০ লাখ পুরুষ ও ২৭ লাখ ৬০ হাজার নারী কর্মক্ষম আছেন।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সেলিম রায়হান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাংলাদেশ এখনো তার শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। সঠিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাবে জনশক্তিকে উত্পাদনশীল করে তোলা যায়নি।'

তিনি মনে করেন, 'এখনো আমাদের বিপুল সংখ্যক মানুষ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাচ্ছেন না।'

বেকারত্বের পাশাপাশি, অব্যবহৃত শ্রমশক্তিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি হচ্ছে—স্বল্প সময়ের জন্য বেকার ও অপরটি হচ্ছে সম্ভাব্য শ্রমশক্তি।

স্বল্প সময়ের জন্য বেকার ব্যক্তি সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টারও কম কাজ করেন।

বিবিএসের দৃষ্টিতে, সম্ভাব্য শ্রমশক্তি বলতে তাদেরকে বোঝায় যারা চাকরিতে নেই এবং বিদ্যমান পরিস্থিতি তাদের কাজ পাওয়া অনুকূলে নয়। যদিও তারা এ ধরনের কাজ করতে আগ্রহী।

বছরের পর বছর ধরে মেধা-শ্রম কাজে লাগানো যাচ্ছে না এমন কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। যেমন, গত পাঁচ বছরে প্রায় দুই লাখ মানুষের মেধা-শ্রম কাজে লাগানো যায়নি।

সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট রিসার্চের নির্বাহী চেয়ারপারসন রুশিদান ইসলাম রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মেধা-শ্রম কাজে লাগানো যাচ্ছে না এমন কর্মীর সংখ্যা আপাতদৃষ্টিতে উদ্বেগজনক মনে নাও হতে পারে।'

তার মতে, 'বিবিএস বেকারত্বের যে সংজ্ঞা দেয় তা খুবই সীমাবদ্ধ। তাছাড়া পুরুষ শ্রমশক্তির মধ্যে এই সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।'

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক এই গবেষণা পরিচালক আরও বলেন, 'তারা অনিয়মিত বা দিন-ভিত্তিক যেসব কাজ করেন, সেখানে উৎপাদনশীলতা কম।'

'এটা উদ্বেগের বিষয়' বলেও মন্তব্য করেন রুশিদান ইসলাম রহমান।

তিনি সতর্ক করে বলেন, 'কম উৎপাদনশীলতা, অপর্যাপ্ত সময় কাজ ও অনিয়মিত কাজে কম মজুরি পাওয়া মানুষ ও তাদের পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যেতে পারে।'

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা মনে করেন, কর্মসংস্থানের গতি ধীর এমন পরিস্থিতির অন্যতম প্রধান কারণ।

তিনি বলেন, 'তাছাড়া নিয়োগকর্তা ও কর্মীদের প্রত্যাশার মধ্যে বড় ধরনের ফারাক আছে।'

'প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে কাজ করে না' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'তাই নিয়োগকর্তারা দক্ষ কর্মী পাচ্ছেন না।'

অধ্যাপক বিদিশা আরও বলেন, 'অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত শ্রমিক প্রত্যাশা মতো চাকরি না পাওয়ায় শ্রমবাজারে ঢুকতে পারছেন না বা তারা গ্রামাঞ্চলে যেতে চাচ্ছেন না।'

নিয়োগকর্তা ও চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান কমাতে যথাযথ প্ল্যাটফর্মের অভাবকেও দায়ী করে তিনি বলেন, 'শ্রমবাজারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে জোরালো সংযোগের অভাব। অর্থাৎ, শিক্ষাব্যবস্থা ও শ্রমবাজারের চাহিদার মধ্যে ব্যবধান অনেক।'

তিনি আরও বলেন, 'এটি জ্ঞান অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে। উত্পাদন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এটি জিডিপিকে প্রভাবিত করে, কর্মীর দক্ষতার অপচয় ঘটায় ও বেকারত্ব বাড়ায়।'

অধ্যাপক বিদিশা মনে করেন, তরুণদের কর্মসংস্থান খুবই জরুরি। কারণ দেশে জনসংখ্যা সংক্রান্ত পরিবর্তন ঘটছে। তরুণ জনসংখ্যার সুবিধা ২০৪০ সালের দিকে বন্ধ হয়ে যাবে।

অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'বাংলাদেশ নানা খাতে, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। কারণ, দেশে পর্যাপ্ত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হয়নি।'

তার মতে, 'যদিও সংখ্যাটি দেখতে অনেক বেশি, তবে তাদের উত্পাদনশীলতা কম বলে মনে হয়। ফলে মানুষ কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন।'

বর্তমানে বাংলাদেশ বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ওপর ভিত্তি করে জনসংখ্যার বাড়তি সুবিধা ভোগ করছে। কিন্তু শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে প্রস্তুত না করায় এর সুফল বেশিদিন স্থায়ী হবে না বলেও মনে করেন তিনি।

Comments