নির্বাচনের আগে বেড়েছে খাদ্য সহায়তা

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরে গত ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মতো প্রকল্পগুলোর আওতায় ১২ লাখ ৯২ হাজার টন চাল ও গম বিতরণ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল সাড়ে ১০ লাখ টন।
ভর্তুকি দামে খাদ্যপণ্য
ভর্তুকি দামে খাদ্যপণ্য কিনতে সাধারণ মানুষের ভিড়। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

দেশে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সাধারণ মানুষের মধ্যে খাদ্যশস্য বিতরণ ২৩ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার এই জনপ্রিয় উদ্যোগটির পরিধি বাড়িয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরে গত ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মতো প্রকল্পগুলোর আওতায় ১২ লাখ ৯২ হাজার টন চাল ও গম বিতরণ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল সাড়ে ১০ লাখ টন।

আগামী ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সেলিম রায়হান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্বাচনের কারণে হয়তো বেশি করে খাদ্যশস্য বিতরণ করা হচ্ছে।'

গত ১৮ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় তা সরকারের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্য মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তা নিম্ন আয়ের মানুষদের ক্রয় ক্ষমতা আরও কমিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে জানা যায়, গত অক্টোবরে টানা তৃতীয় মাসে দেশে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের বেশি ছিল। এটি গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

অধ্যাপক সেলিম রায়হান আরও বলেন, 'মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পর থেকে অর্থনীতিবিদরা মানুষের উপকারের কথা বিবেচনা করে সরকারকে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচির পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।'

বেশি পরিমাণে বিতরণের কারণে গত ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারের খাদ্য মজুদ কমে দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৯৩ হাজার টন। এটি এর আগের বছরের একই দিনে ছিল ১৫ লাখ ৮২ হাজার টন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় দেশে খাদ্য মজুদ ছিল গড়ে ১৮-১৯ লাখ টন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের মহাপরিচালক কাজী শাহাবুদ্দীন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক সময় ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ দেশের জন্য যথেষ্ট বলে ধরে নেওয়া হলেও এখন তা ১০-১৫ লাখ টন হওয়া উচিত।'

'সুতরাং সেই হিসাবে দেশের বর্তমান খাদ্য মজুদ ঠিক আছে,' বলে মনে করেন তিনি।

তিনি সরকারের খাদ্যশস্য মজুদের ব্যবস্থাকে 'সুড়ঙ্গ' হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি একদিকে ভরা হয় ও অন্যদিক থেকে বিতরণ করা হয়।

তিনি মনে করেন, 'বেশি বিতরণের ফলে মজুদ কমে গেলেও আমন সংগ্রহের পর তা বাড়বে।'

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জনগণের দুর্দশা কমাতে সরকার সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য বিতরণ করেছে। এ কারণে মজুদ কমেছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যেহেতু আমনের ফলন ভালো হয়েছে এবং সরকার শিগগিরই চাল কিনতে যাচ্ছে, তাই মজুদ বাড়বে।'

নির্বাচনকে সামনে রেখে নানান কর্মসূচির আওতায় সরকার পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য বিতরণকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ ছাড়াও, ভর্তুকির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে যাতে খাদ্য বিতরণ সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে।

ওএমএস পদ্ধতিতে সরকার জুলাই থেকে নভেম্বরে চার লাখ ৩৯ হাজার টন চাল ও গম বিতরণ করেছে। এটি এর আগের বছরের একই সময়ে ছিল দুই লাখ ৯২ হাজার টন।

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে চার লাখ ১৫ হাজার টন গম ও চাল সরবরাহ করা হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ছিল দুই লাখ ৮৫ হাজার টন।

বেশ কয়েকটি প্রকল্পের আওতায় খাদ্যশস্য বিতরণ দ্রুত বেড়েছে। এটি জুলাই থেকে নভেম্বরে ছিল এক লাখ ৬৪ হাজার টন। এক বছর আগে তা ছিল ২৭ হাজার ৬৫৮ টন।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান সম্প্রতি জানান, ভর্তুকি দেওয়া খাদ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর টিসিবি ট্রাকে করে খাদ্যপণ্য বিক্রি আবার শুরু করেছে।

বর্তমানে ঢাকার ৩০টি জায়গায় টিসিবির ট্রাকে প্রতিদিন ৭২ টন খাদ্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে।

'সরকারের খাদ্যমজুদ কমে গেলেও চাল আমদানি হয়নি' উল্লেখ করে কাজী শাহাবুদ্দীন আরও বলেন, 'এর কারণ দেশে চালের ঘাটতি নেই।'

'তাছাড়া আমাদের বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা আছে,' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'দেশে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষতি হয়, তখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল কিনতে হয়। সৌভাগ্যবশত এ বছর দেশে বড় কোনো দুর্যোগ ঘটেনি।'

চাল ব্যবসায়ী চিত্ত মজুমদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ বছর চাল বিক্রি কম হওয়ায় গত বছর আমদানি করা সব চাল ব্যবসায়ীরা এখনো বিক্রি করতে পারেননি।'

গত বছরের নভেম্বরে সরকার বলেছিল, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করায় তা এড়াতে বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতি ইঞ্চি জমিতে ফসল ফলাতে হবে এবং সঞ্চয়ের পাশাপাশি খরচ কমাতে হবে।

চিত্ত মজুমদার জানান, সরকার যখন সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করেছিল, তখন ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করেন। তবে দেশে চাল বিক্রি এখন তুলনামূলক কম।

'বড় ব্যবসায়ীরা এই মুহূর্তে খাদ্যশস্য আমদানি করছেন না' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল আমন ধানের বাম্পার ফলন চাল আমদানি কমার আরেকটি কারণ।'

চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকারি ও বেসরকারিভাবে চাল আমদানি হয়নি। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা যায়, গত অর্থবছরে চাল আমদানি হয়েছিল ১০ লাখ ৫৫ হাজার টন। এর মধ্যে সরকারের আমদানি ছিল ছয় লাখ ৩৩ হাজার টন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজেটে বরাদ্দ থাকলেও এ বছর চাল আমদানির পরিকল্পনা নেই।'

Comments