১ বছরে হ্যান্ডসেটের স্থানীয় উৎপাদন কমেছে ২৬ শতাংশ

করোনা মহামারির কারণে মোবাইল ডিভাইস কম্পোনেন্টের বাজারে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া সত্ত্বেও ২০২১ সালে দুই কোটি ৯৫ লাখ হ্যান্ডসেট তৈরি করা হয়েছিল।
মোবাইল ফোন
গাজীপুরে মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরির কারখানা। ছবি: সংগৃহীত

ডলারের বেশি দাম, বাড়তি করের পাশাপাশি ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ায় দেশে মোবাইল ফোন বিক্রি কমেছে। এমন পরিস্থিতিতে কমেছে স্থানীয়ভাবে তৈরি মোবাইল ফোন সেটের সংখ্যা।

২০১৭ সালের পর গত বছর প্রথম দেশে হ্যান্ডসেটের উৎপাদন কমলো।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুসারে, গত বছর দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো দুই কোটি ৩৩ লাখ মোবাইল ফোন সেট তৈরি করেছিল। এটি ২০২২ সালে তৈরি করা তিন কোটি ১৭ লাখ সেটের তুলনায় ২৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ কম।

সংশ্লিষ্টদের মতে, এমন পরিস্থিতির জন্য ডলারের বেশি দাম ও বাড়তি কর দায়ী।

গত দুই বছর ধরে ক্রমবর্ধমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতারা তাদের খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দিয়েছেন। বাজার মন্দা এই শিল্পের জন্য আরেকটি বড় হুমকি তৈরি করেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটগুলো মিলে স্থানীয় মোবাইল সেট উত্পাদন শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ ছাড়া, এলসি খোলার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ পুরো সরবরাহ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে।

তারা আরও বলছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে হ্যান্ডসেটের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আগের পর্যায়ে না এলে এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে বা প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাধাপ্রাপ্ত হবে।

মন্দা এতটাই প্রভাব ফেলছে যে ২০২৩ সালে স্থানীয়ভাবে তৈরি ফোনের সংখ্যা ২০২০ সালের তুলনায় আরও কম। ২০২০ সালে দুই কোটি ৪০ লাখের বেশি হ্যান্ডসেট তৈরি করা হয়েছিল।

করোনা মহামারির কারণে মোবাইল ডিভাইস কম্পোনেন্টের বাজারে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়া সত্ত্বেও ২০২১ সালে দুই কোটি ৯৫ লাখ হ্যান্ডসেট তৈরি করা হয়েছিল।

২০২২ সালে স্থানীয়ভাবে তিন কোটি ১৬ লাখ হ্যান্ডসেট উৎপাদিত হয়েছে। এটি আনুষ্ঠানিক স্থানীয় চাহিদার ৯৯ শতাংশ।

মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমপিআইওএবি) তথ্যে জানা যায়, গত বছর মোবাইল ফোন বিক্রি কমেছে ৩৩ শতাংশ।

ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্কে হ্যান্ডসেট বিক্রেতা ফোন জোন বিডির বিক্রয় প্রতিনিধি মো. জুয়েল দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তার দোকানে বিক্রি অর্ধেকের বেশি কমেছে।

তিনি বলেন, 'আমরা যদি আগে ১০টি ফোন বিক্রি করতে পারতাম, এখন তা চারে নেমেছে।' তিনি মনে করেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াই ফোন বিক্রি কমে যাওয়ার মূল কারণ।

এমপিআইওএবির সহ-সভাপতি রিজওয়ানুল হকের মতে, বাজারে মন্দাভাব চলমান থাকা এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

তার মতে, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নতি হতে সময় লাগবে।

রিজওয়ানুল হক বলেন, 'এটি সত্য যে অর্থনৈতিক প্রভাব ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বাজার মন্দা একটি বড় কারণ।'

তিনি আরও বলেন, 'নির্বাচন শেষ হওয়ায় অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা দূর হয়েছে। আশা করি, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে।'

'দেশীয় মোবাইল কারখানাগুলোর পুনরুজ্জীবন নির্ভর করছে বাজারের মন্দাভাব ও ডলার সংকট কাটানোর ওপর,' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অবৈধভাবে দেশে আসা হ্যান্ডসেটগুলো বর্তমানে বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ দখল করে রেখেছে।'

কর কমানো অযৌক্তিক মনে হলে বাজারের মন্দাভাব কাটাতে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

একটি প্রস্তাবিত সমাধানের মধ্যে আছে স্থানীয় মোবাইল ফোন উত্পাদন খাতকে সুরক্ষিত করতে জাতীয় সরঞ্জাম পরিচয় নিবন্ধন (এনইআইআর) গ্রহণ করা।

২০২১ সালে বিটিআরসি প্রবর্তিত এনইআইআরের লক্ষ্য ছিল গ্রাহকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও সিম নম্বরের সঙ্গে তাদের আইএমইআই নম্বর সংযুক্ত করে দেশে বৈধ মোবাইল ফোন ব্যবহার নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশ আগেভাগে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও অন্যান্য দেশ তা বাস্তবায়ন কলে ফেলতে পেরেছে।

যেমন—পাকিস্তান ও নেপাল অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ এবং স্থানীয় উত্পাদনকারীদের সহায়তা করতে এনইআইআর ব্যবহার করছে।

কিন্তু বাংলাদেশে নকল, অননুমোদিত বা ক্লোন হ্যান্ডসেট ব্লক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগগুলো এখনো কার্যকর হয়নি। চোরাইপথে দেশে আনা মোবাইল ফোন ব্লক করার উদ্যোগও সরকার নেয়নি।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, গত দুই বছর ধরে বিক্রি ও উত্পাদন পর্যায়ে ভ্যাট নেওয়ায় তা স্থানীয় নির্মাতাদের দুর্দশাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকার ঘোষিত বিপুল কর সুবিধার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে হ্যান্ডসেট উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে গতি অর্জন করে।

এরপর থেকে এ পর্যন্ত ১৭ কারখানা হয়েছে। এতে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ কাজ করছেন।

২০২০-২১ সালের আগে মোবাইল ফোন আমদানিতে প্রায় ৫৮ শতাংশ কর ছিল। স্থানীয়ভাবে সংযোজিত ও উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ওপর কর ছিল ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।

পরে কারখানা থেকে পরিবেশক হয়ে খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত বিক্রির তিন ধাপের প্রতিটিতে পাঁচ শতাংশ ভ্যাটের কারণে তা ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়।

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই উৎপাদন পর্যায়ে আরও ভ্যাট আরোপ করে রাজস্ব বোর্ড।

সম্পূর্ণ স্থানীয়ভাবে তৈরি যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে এমন পণ্যের ওপর প্রথমবারের মতো অতিরিক্ত দুই শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।

এ ছাড়াও, স্থানীয়ভাবে তৈরি অন্তত দুটি যন্ত্রাংশ দিয়ে উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট তিন থেকে বাড়িয়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে।

একইভাবে আমদানি করা যন্ত্রাংশ দিয়ে সংযোজিত হ্যান্ডসেটের ওপর ভ্যাট পাঁচ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে সাত শতাংশ করা হয়েছে।

সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে আইসিটি সেবা ও ডিজিটাল ডিভাইস রপ্তানি করে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর বড় অংশ ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন সেট রপ্তানি থেকে আসে।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন—সিম্ফনি ও ওয়ালটন যুক্তরাষ্ট্র ও নেপালে কিছু হ্যান্ডসেট পাঠালেও এর পরিমাণ ও দাম কম থাকায় রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নাও হতে পারে।

Comments