শর্ত মেনেই আইএমএফের ঋণ, আরও ৭৬২ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি পাওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক চুক্তিতে পৌঁছেছে সরকার। এতে করে ঋণ ছাড়ে গত কয়েক মাস ধরে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছিল সেটি দূর হয়েছে।
এছাড়াও, আইএমএফ গতকাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে 'গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ' মোকাবিলায় অতিরিক্ত ৭৬২ মিলিয়ন ডলার চেয়েছে বাংলাদেশ।
প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের দুটি কিস্তি ছাড় এবং ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর অনুরোধ - দুটোই এখন আইএমএফ বোর্ডের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
বিবৃতিতে বাংলাদেশে আইএমএফের মিশন প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও বলেছেন, বোর্ডের অনুমোদন নির্ভর করছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি এবং বিনিময় হার সংস্কার পুরোপুরি বাস্তবায়নের মতো কিছু পূর্ব শর্ত পূরণের ওপর।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সরকার সংস্কার কর্মসূচির লক্ষ্য পূরণে পুনরায় তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক অর্থের ঘাটতি মেটাতে রাজস্ব সংস্কার, মুদ্রাস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি সমন্বয় এবং নমনীয়তা বাড়াতে বিনিময় হার সংস্কার ও বাস্তবায়ন।
আইএমএফ বলেছে যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে আছে, ট্যাক্স বা কর ছাড়ের বিষয়টি সহজ করা, সবাই যেন ঠিকমতো কর দেয় তা নিশ্চিত করা এবং কর নীতি তৈরি ও তা আদায়ের দায়িত্ব আলাদা করা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ব্যয় কমিয়ে আনতে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের কথাও বলেছে সংস্থাটি।
নমনীয় নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থার কঠোর বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছে আইএমএফ।
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, বিনিময় হার নীতি ও অন্যান্য কাঠামোগত ক্ষেত্রে সংস্কারসহ সব বিষয়ই সতর্কভাবে পর্যালোচনা করে দুই পক্ষ চুক্তিতে পৌঁছেছে বলে গতকাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এই অগ্রগতি বিদেশি অর্থায়নের পথ উন্মুক্ত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকার আশা করছে, জুনের মধ্যে বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় দাতার কাছ থেকে মোট ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পাওয়া যাবে।
এর মধ্যে আইএমএফ থেকে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পাশাপাশি আরও ২ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা আশা করা হচ্ছে, যা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের মতো উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আসবে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
এই তহবিল দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও শক্তিশালী করবে, যা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৭ মে পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ২৯ বিলিয়ন ডলারে।
উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে বাজেট সহায়তা পেতে যেসব সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে তা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নেওয়া হয়েছে এবং জাতীয় স্বার্থে গ্রহণ করা হয়েছে বলে গতকাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
নতুন কর পরিকল্পনার আওতায়, আগামী অর্থবছরে অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহে সম্মত হয়েছে সরকার, যা আইএমএফ অনুমোদিত কর ব্যবস্থার আওতায় পড়ছে। এর অংশ হিসেবে কিছু পণ্যে মূসক বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হবে, কর অবকাশ সুবিধা কমানো হবে এবং বিভিন্ন কর ছাড় তুলে নেওয়া হবে।
প্রথমদিকে আইএমএফ জাতীয় জিডিপির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ সমপরিমাণ অতিরিক্ত রাজস্ব আহরণের সুপারিশ করেছিল।
তবে একাধিক বৈঠকের পর উভয় পক্ষ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশে সম্মত হয়, যা থেকে আনুমানিক ৪০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আসবে। এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে।
২ বিলিয়ন ডলারের বাজেট সহায়তার মধ্যে বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ৫০০ মিলিয়ন ডলার পাবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা সম্ভব হয়েছে আইএমএফের পরামর্শে সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দেওয়ায়।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার এনবিআর ভেঙে দিয়েছে এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি আলাদা বিভাগ তৈরি করেছে, -রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা, যিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার অনুমতিপ্রাপ্ত নন এবং নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এটা (এনবিআর ভেঙে দেওয়া) শুধু আইএমএফের শর্ত ছিল না, বিশ্বব্যাংকেরও শর্ত ছিল।
কর্মকর্তারা জানান, এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ৯০০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে—এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন ব্যাংক খাতে সংস্কার কার্যক্রমে এবং ৪০০ মিলিয়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ব্যবহার করা হবে।
এছাড়াও, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) ৪০০ মিলিয়ন ডলার এবং এজেন্স ফ্রঁসেজ দে ডেভেলপমেন্ট (এএফডি) ১০০ মিলিয়ন ডলার দেবে, যা এডিবির প্রকল্পের সাথে যৌথভাবে অর্থায়ন করা হবে।
তাছাড়া, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন জোরদার করার জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে।
Comments