ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কিনলে বেশি লোকসান

গত অর্থবছরে অন্তত ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকারীরা চলতি বছরের গত প্রথম চার মাসে লোকসানে পড়েছেন। অন্যদিকে, যারা ১৫ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার নিয়ে ‘বাজি’ ধরছেন, তাদের পকেট ভারী হয়েছে।
শেয়ারবাজার
যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে মুনাফা ও লেনদেনের তালিকার শীর্ষে থাকে পুঁজিবাজারে সেগুলো এখন ধুঁকছে। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

বিনিয়োগকারীরা যদি ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করেন তবে তারা সাধারণত ভালো মুনাফা করতে পারেন। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের লাভবান করে। পাশাপাশি তাদের শেয়ারদামও ঊর্ধ্বমূখী থাকে। অথচ, গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে এর উল্টো চিত্র দেখা যায়।

গত অর্থবছরে অন্তত ৫০ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগকারীরা চলতি বছরের গত প্রথম চার মাসে লোকসানে পড়েছেন। অন্যদিকে, যারা ১৫ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার নিয়ে 'বাজি' ধরছেন, তাদের পকেট ভারী হয়েছে।

গত চার মাসে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত ইউনাইটেড পাওয়ার, ওয়ালটন, এসিআই, রেনাটা, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলসের শেয়ারের দাম ৩০ শতাংশের বেশি কমেছে। গ্রামীণফোনের শেয়ারের দাম কমেছে ১৭ শতাংশ।

একই সময়ে কম মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি হিসেবে বিবেচিত বাংলাদেশ মনোসপুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিং, তৌফিকা ফুডস ও লাভেলো আইসক্রিম, পেপার প্রসেসিং, খান ব্রাদার্স পিপি ওভেন ব্যাগ ও বিচ হ্যাচারির শেয়ারের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি।

বিএটিবিসি, ওয়ালটন ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ার কেনা ব্যাংক কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ আশানুরূপ মুনাফা না পাওয়ায় হতাশ।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজার বিশ্লেষকরা সব সময় বলে থাকেন—ভালো শেয়ারে বিনিয়োগ করলে কখনোই লোকসান হবে না। আমি সবসময় তাদের পরামর্শ শুনি। ভালো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু, আমার শেয়ারের দাম ২০ শতাংশ কমে গেছে।'

তার অভিযোগ, 'বাজিকররা' শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দেবে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ায় তার কয়েকজন বন্ধু লাভেলোর শেয়ার কেনেন। গুজবটি সত্য বলে প্রমাণিত হয়। ওই প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে।

নূর মোহাম্মদ আরও বলেন, 'ভালো বিনিয়োগকারীরা কীভাবে এমন কারসাজির বাজারে টিকে থাকবেন? এটা ভালো বিনিয়োগকারীদের বাজার নয়।'

গত অর্থবছরে ৮০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া ব্লু-চিপ প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশনের শেয়ারের দাম গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিলে কমেছে ৪৭ শতাংশ। দেশের শীর্ষ ইলেকট্রনিক্স পণ্য প্রস্তুতকারক ওয়ালটন ৩০০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও এর শেয়ারের দাম কমেছে ৪২ শতাংশ।

কয়েকটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের মালিকানাধীন ও ৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান এসিআইয়ের শেয়ারের দাম ৪৬ শতাংশ কমেছে। দেশের অন্যতম শীর্ষ ওষুধ প্রতিষ্ঠান রেনাটা গত অর্থবছরে সাড়ে ৬২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিলেও এর শেয়ারে দাম কমেছে ৩৭ শতাংশ।

শীর্ষ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর শেয়ারের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ। গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি শতভাগ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।

সব মিলিয়ে জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ব্লু-চিপ শেয়ারের সূচক আট শতাংশ কমে এক হাজার ৯৯৫ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।

অন্যদিকে, ১৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া স্বল্প পরিশোধিত মূলধনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মনোসপুল পেপার ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের শেয়ারের দাম গত চার মাসে ১২৬ শতাংশ বেড়ে পুঁজিবাজারে শীর্ষে।

দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল তৌফিকা ফুডস ও লাভেলো আইসক্রিম পিএলসি। এর শেয়ারের দাম দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। পেপার প্রসেসিং ও প্যাকেজিংও দ্বিগুণ হয়েছে।

গত অর্থবছরে লাভেলো ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েছিল। এর ১২ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ দেওয়ার রেকর্ড ছিল না। আগের বছর পেপার প্রসেসিং ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত দুই বছর ধরে পুঁজিবাজার ক্যাসিনোর মতো আচরণ করেছে। দুর্বল শেয়ারের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। সুস্থ বাজারে এটা সম্ভব নয়।'

তিনি আরও বলেন, 'পুঁজিবাজারের আচরণ অস্বাভাবিক। যেসব শেয়ারকে নিয়ে কারসাজির সুযোগ আছে বিনিয়োগকারীরা সেগুলোর পেছনে ছুটছেন। যেসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে মুনাফা ও লেনদেনের তালিকার শীর্ষে থাকে সেগুলো এখন ধুঁকছে।'

তার মতে, 'শুধু কারসাজিই নিম্নমানের শেয়ারের দাম উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। দুর্ভাগ্যবশত, নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কারসাজির বিষয়ে অন্ধের মতো আচরণ করছে।'

পুঁজিবাজার নিয়ম মেনে না চলায় ভালো বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে বছরের শেষ প্রান্তিকে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি মুনাফা করলেও তাদের শেয়ারের দাম কমেছে।

'বিনিয়োগকারীরা যে কোনো উপায়ে বাজার ছাড়ার চেষ্টা করছেন' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুসারে, গত দুই বছরে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমেছে ২০ লাখ বা প্রায় ১৪ শতাংশ।

খারাপ শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়া ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসহ ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম কমে যাওয়াকে পুঁজিবাজারে সুশাসনের অভাবকে দায়ী করেছেন ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন আন্ডারপারফর্মিং প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, তখন নিয়ন্ত্রকদের হস্তক্ষেপ করা উচিত। এর জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত।'

শুধু বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন নয়, স্টক এক্সচেঞ্জগুলোরও নজরদারির সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

'প্রবৃদ্ধির পথে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের আয় কম থাকলেও শেয়ারের ঊর্ধ্বমুখী দামের প্রবণতা থাকতে পারে। তবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রবৃদ্ধি সীমাবদ্ধ,' যোগ করেন তিনি।

আরেকটি কারণ হলো দেশে সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সাধারণত ভালো শেয়ার কিনে এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য বিনিয়োগ করে।

সাইফুল ইসলামের মতে, খারাপ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় কম ও ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর আছে বিশাল মূলধন।

তিনি বলেন, 'বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ারের অস্বাভাবিক দরপতন দেখেন তখন তারা বাজার ছেড়ে চলে যান। বাংলাদেশে ঠিক এটাই ঘটছে।'

তিনি মনে করেন, তরুণরা ক্রমাগত পুঁজিবাজারের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে তারা পুঁজিবাজারে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী হবেন না।

'ব্লু-চিপ শেয়ারগুলো যখন ধুঁকে তখন ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোও তালিকাভূক্ত হতে নিরাশ হয়।'

বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'চাহিদা ও সরবরাহের ওপর ভিত্তি করে শেয়ারের বাজারমূল্য নির্ধারিত হয়। এরপরও কেউ নিয়ম ভাঙলে ব্যবস্থা নেব।'

'কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের লেনদেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে' উল্লেখ করে তিনি জানান, তাদের ওপর নজরদারি রাখা হচ্ছে।

মোহাম্মদ রেজাউল করিম আরও বলেন, 'ফ্লোর প্রাইসের কারণে ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ার দীর্ঘদিন ধরে একই দামে আটকে ছিল। বিনিয়োগকারীদের কেউ কেউ হয়ত শেয়ার বিক্রির চাপে আছেন।'

Comments

The Daily Star  | English

Floods cause Tk 14,421 crore damage in eastern Bangladesh: CPD study

The study highlighted that the damage represents 1.81 percent of the national budget for fiscal year (FY) 2024-25

2h ago