তিন মাসে সূচক কমেছে ১০০০ পয়েন্ট, আতঙ্কে শেয়ারবাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা

এ সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন বা টাকার অংকে শেয়ার মূল্য কমেছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা বা ১৫ শতাংশ।
শেয়ারবাজার, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, ডিএসই, ফ্লোর প্রাইস, বিএসইসি,
অলঙ্করণ: বিপ্লব চক্রবর্তী

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি অব্যাহত রাখায় গত তিন মাসের ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক এক হাজার পয়েন্ট কমেছে। কারণ শেয়ার বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা দেশের অর্থনৈতিক সূচকের আরও অবনতি হতে পারে।

এ বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১ হাজার ২২ পয়েন্ট বা ১৬ শতাংশ কমে ৫ হাজার ২৫০ পয়েন্টে নেমেছে গত রবিবার পর্যন্ত। আজ সোমবার সেটি কিছুটা বেড়ে ৫ হাজার ৩১০ পয়েন্টে উঠে এসেছে।

এ সময়ে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন বা টাকার অংকে শেয়ার মূল্য কমেছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা বা ১৫ শতাংশ।

মূলত চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর সূচকের তীব্র পতন শুরু হয়।

এর আগে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখে দিলে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফ্লোর প্রাইস চালু করেছিল বিএসইসি। মূলত শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে ফ্লোর প্রাইস চালু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। কিন্তু বিএসইসির এ সিদ্ধান্ত সূচকের পতন ঠেকাতে পারেনি।

দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, 'মূলত দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের অবনতির কারণে শেয়াবাজারে সূচকের পতন হয়েছে। সব মিলিয়ে এখানের বিনিয়োগকারীরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছেন। তাই তারা শেয়ার বিক্রি অব্যাহত রেখেছেন।'

তার ভাষ্য, যখন দেশের অর্থনীতির সূচকগুলো ভালো অবস্থানে থাকে না, তখন তার প্রভাব পড়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পারফরম্যান্সের ওপর। এতে এসব কোম্পানির শেয়ারের দামও কমে যায়।

তিনি আরও জানান, অন্যদিকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার বেড়ে ১২ শতাংশের বেশি হয়েছে। তাই বিনিয়োগকারীরা স্বাভাবিকভাবেই তাদের অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করবেন। সেটাই যৌক্তিক বলে আমি মনে করি।

'এদিকে সরকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। তাই ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে। এর প্রভাব গিয়ে পড়েছে ব্যাংকের তারল্যে, সেখানে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

এর বাইরে বিনিয়োগকারীরা এখন আগামী বাজেটে মূলধনী মুনাফায় কর পুনঃস্থাপনসহ সম্ভাব্য কিছু বিষয়ে উদ্বিগ্ন বলে জানিয়েছেন তিনি।

আবার বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকে তাকালে দেখা যাবে, ডলারের বিপরীতে টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। এতে বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগও কমছে।

এছাড়া অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিদেশি আমানত সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে এখন আর বিদেশি বিনিয়োগকারীকে টাকার অবমূল্যায়ন নিয়ে ভাবতে হবে না। তারা ৮ শতাংশের বেশি সুদ পাবেন আমানত রাখলেই।

মার্চে কার্যকর হওয়া অফশোর ব্যাংকিং অ্যাক্ট-২০২৪ অনুযায়ী, তিন মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে তারা মার্কিন ডলার বা ইউরোতে ফিক্সড ডিপোজিটের ওপর ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ পর্যন্ত করমুক্ত মুনাফা সুবিধা পাবেন।

ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, 'তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যদি এভাবে বেশি সুদের সুবিধা পায়, আবার বিনিয়োগও নিরাপদ থাকে- তাহলে তারা কেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি নেবে?'

তাই চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বড় আকারে শেয়ার বিক্রি শুরু করেন।

ইউসিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী শেখ মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, 'শেয়ার বিনিয়োগকারীরা এখন বেশ উদ্বিগ্ন। তারা ভাবছেন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে, আর সেই আশঙ্কা থেকে শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছেন।'

'আমি মনে করি, বিনিয়োগকারীরা অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। তাদের মনে রাখা উচিৎ, ভুলত্রুটি সংশোধনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্য বেশ কিছু বড় উদ্যোগ নিয়েছে...' বলেন তিনি।

যেমন চলতি মাসের শুরুর দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারভিত্তিক সুদহারের অনুমতি দিয়েছে। শুধু তাই নয় নতুন বিনিময় হার পদ্ধতি ক্রলিং পেগ চালু করেছে। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদহারও বাড়িয়েছে।

রাশেদুল হাসান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগগুলো সামষ্টিক অর্থনীতির সূচক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু বিনিয়োগকারীরা সেটাকে এক প্রকার উপেক্ষাই করছেন।

তিনি মন্তব্য করেন, শুধু এক বা দুই প্রান্তিকে আয় কমে গেছে বলে ব্লু-চিপ কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করা উচিত নয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এসব কোম্পানি সমস্যার মুখে পড়েছে, হয়তো শিগগিরই ঘুরে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল।

তিনি আরও বলেন, পুজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিছু নীতি নিয়েছিল। এসব নীতিতে কিছু ভুলভ্রান্তি ছিল। ইতোমধ্যে পুরো বাজারকে তার মূল্য দিতে হয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে তিনি ফ্লোর প্রাইস চালু ও বছরের পর বছর ধরে ডলারের বিপরীতে টাকাকে শক্তিশালী রাখার নীতির কথা উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, 'এখন যদি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে এসে শেয়ার কেনে। তাহলে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে।'

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, প্রবাসী ও রপ্তানি আয়সহ অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের অবস্থা ভালো না হওয়ায় বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রিজার্ভ রেকর্ড ৪১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে তা অর্ধেকেরও বেশি কমে ১৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩৫ শতাংশ।

তিনি বলেন, 'এছাড়া জোরপূর্বক শেয়ার বিক্রির (ফোর্সড সেল) কারণে সূচকের দরপতন হয়েছে।'

মূলত বিনিয়োগকারীরা ঋণে শেয়ার কিনলে ও শেয়ারের দাম কমে গেলে মার্চেন্ট ব্যাংকার ও স্টক ব্রোকাররা বন্ধকমুক্ত এই ঋণের টাকা বাঁচাতে শেয়ার বিক্রি করে। শেয়ারবাজারের পরিভাষায় এটি জোরপূর্বক বিক্রি হিসেবে পরিচিত।

মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, 'ঋণ নিয়ে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা উচিত নয়।'

সূচকের দ্রুত পতনের কারণে বিনিয়োগকারীরা বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ৪ শতাংশেরও বেশি কমে ১৭ লাখ ৯০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English
Bangladeshi-Americans eager to help build new Bangladesh

July uprising and some thoughts of Bangladeshi-Americans

NRBs gathered in New Jersey showed eagerness to assist in the journey of the new Bangladesh forward.

9h ago