পুঁজিবাজার: বিদেশে রোড শো’র নামে অর্থ অপচয়

তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলেছিল, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ও শেয়ারবাজার চাঙা করতে এই আয়োজন। যদিও এভাবে রোড শো করে বিদেশি বিনিয়োগ টানা বিএসইসির দায়িত্ব নয়, তাছাড়া তালিকাভূক্ত কোম্পানির টাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুষ্ঠান আয়োজন আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ২০২০ সালের মে মাসে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। নিয়োগের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তিনি বিদেশে রোড শো শুরু করেন।

তখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বলেছিল, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ও শেয়ারবাজার চাঙা করতে এই আয়োজন। যদিও এভাবে রোড শো করে বিদেশি বিনিয়োগ টানা বিএসইসির দায়িত্ব নয়, তাছাড়া তালিকাভূক্ত কোম্পানির টাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুষ্ঠান আয়োজন আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রথম রোড শো অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের বেশিরভাগ দেশীয় মধ্যস্থতাকারী, ব্যবসায়ী ও অনাবাসী বাংলাদেশি। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণে এই আয়োজন হলেও সেখানে বিদেশিদের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম।

এরপর পর্যায়ক্রমে ১১টি দেশে ১৭টি রোড শো করেছিল বিএসইসি। এসব অনুষ্ঠান আয়োজনের বেশিরভাগ অর্থ যোগান দেওয়া হয়েছে হাজার হাজার সাধারণ বিনিয়োগকারীর মালিকানাধীন তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও শেয়ারবাজারের মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে। সে অনুষ্ঠানগুলোতেও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতি ছিল অতি নগণ্য।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠান রোড শো পৃষ্ঠপোষকতা করতে অন্তত ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

বিভিন্ন কোম্পানির কর্মকর্তারা বলেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার চাপে তাদের এই অর্থ দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না।

কিন্তু বিনিয়োগযোগ্য কোম্পানি ও সুশাসনের অভাব, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ঘন ঘন নীতি পরিবর্তনের কারণে ব্যয়বহুল রোড শো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এভাবে শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ ব্যয় করা কতটা যুক্তিসঙ্গত, তা নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার।

যেখানে বিএসইসি বাজারে কারসাজি বন্ধ করতেই তার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ রাখতে পারেনি। পাশাপাশি এখানে সুশাসনও ফেরাতে পারেনি।

ফলে, অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী গত তিন বছরে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে পুঁজিবাজারের বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ১১১ মিলিয়ন ডলার কমেছে। যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল ৩৮ মিলিয়ন ডলার।

তথ্য অনুযায়ী, বিএসইসি একাই তিনটি দেশে সাতটি রোড শো আয়োজন করেছিল। অবশ্য অনেক সমালোচক বলেছিলেন, এ ধরনের রোড শো হোস্ট করা শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব নয়। পরে তারা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সঙ্গে হাত মেলায়।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রথম রোড শোয়ের পৃষ্ঠপোষক ছিল ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ। ব্রোকারেজ ফার্মটি একটি তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান। পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজকে বিএসইসি নিয়ন্ত্রণ করে, যা নিয়ন্ত্রকের জন্য পরিস্থিতি অস্বস্তিকর করে তোলে।

২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের চারটি শহরে যৌথভাবে রোড শোর পৃষ্ঠপোষকতা করে দেশীয় ইলেকট্রনিক্স জায়ান্ট ওয়ালটন ও মোবাইল আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান নগদ।

যে বছর 'নগদ' এ অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করে, সে বছরই বাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও জিরো কুপন বন্ড ইস্যু করে ৫১০ কোটি টাকা সংগ্রহের অনুমোদন পায় কোম্পানিটি।

সুইজারল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুটি শহরে ওয়ালটন এবং যুক্তরাজ্যের দুটি শহরে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় রোড শো অনুষ্ঠিত হয়।

প্রাণ গ্রুপ, আলিফ গ্রুপ, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স এবং এমারেল্ড অয়েলের স্বত্বাধিকারী মিনোরি বাংলাদেশও বেশ কয়েকটি রোড শো পৃষ্ঠপোষকতা করে।

পুঁজিবাজারের মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই), চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই), সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ ও সেন্ট্রাল কাউন্টারপার্টি বাংলাদেশের যৌথ সহায়তায় ফ্রান্স, জার্মানি ও বেলজিয়ামে রোড শো অনুষ্ঠিত হয়।

বেশ কয়েকটি কোম্পানির শীর্ষ কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনুরোধ করায় তারা পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি হয়েছিলেন। তাদের যুক্তি, তারা চাপে পড়ে এটা করেছে, কারণ কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানি নিয়ন্ত্রকের সংস্থার অনুরোধ এড়াতে পারে না।

তারা বলেন, বিএসইসি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে বলেছিল, তিনি এসব অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন এবং পৃষ্ঠপোষকতা করলে খুশি হবেন।

ইবিএলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত একটি রোড শো আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতায় তারা প্রায় দেড় লাখ ডলার খরচ করেছে।

ইউসিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, তারা যুক্তরাজ্যের রোড শোতে পৃষ্ঠপোষকতায় আড়াই লাখ পাউন্ড এবং দুবাই রোড শোতে প্রায় এক কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।

ইউসিবির এই কর্মকর্তা বলেন, 'যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোনো অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করতে বলে, তখন তা উপেক্ষা করার সুযোগ থাকে না।'

ওয়ালটন, ইউসিবি, ডিএসই ও সিএসইর একাধিক কর্মকর্তাও একই কথা বলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, এভাবে রোড শো আয়োজন করা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার দায়িত্ব নয়।

'তাছাড়া তারা যে প্রক্রিয়ায় রোড শো আয়োজন করেছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ,' বলেন তিনি।

তার ভাষ্য, 'যখন একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা তার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সুবিধা নেয়, তখন এটি কীভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।'

আল আমিন বলেন, 'সবচেয়ে বড় কথা, বিএসইসি তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্থ ব্যবহার করেছে, যা শেষ পর্যন্ত শেয়ারহোল্ডারদের অর্থ এবং এটি কোম্পানিগুলোর মুনাফায় প্রভাব ফেলেছে।'

তিনি মন্তব্য করেন, 'রোড শো কি বিনিয়োগকারীদের উপকারে এসেছে? মোটেও না।'

'এ ধরনের রোড শো কেবল বিডা ও সরকারি অর্থায়নে করা যেতে পারে।'

অন্যদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় কমাতে ও বিদেশ ভ্রমণ সীমাবদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার পরও বেশ কয়েকটি রোড শো অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

গত মাসে ব্রাজিলে আরেকটি রোড শো আয়োজনের পরিকল্পনা থাকলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে তা স্থগিত করা হয়।

একজন শীর্ষ ব্যাংকার বলেন, 'আমি জানি না ব্রাজিলে রোড শো আয়োজন করা হলে, তা কীভাবে আমাদের সহায়তা করবে। ব্রাজিলের সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের যোগাযোগ খুব কম। এমনকি আমাদের দেশে ব্রাজিলের উল্লেখযোগ্য কোনো বিনিয়োগ নেই।'

'এটা তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্থ নিয়ে পিকনিকের আয়োজন ছাড়া আর কিছু নয়,' বলেন এই ব্যাংকার।

তাই এসব রোড শো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু, রোড শো করা সত্ত্বেও বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে।

এদিকে রোড শোর ব্যর্থতা ঢাকতে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগের তথ্য প্রকাশ্যে প্রকাশ না করতে ডিএসইকে মৌখিকভাবে নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি।

আল আমিন বলেন, 'ফ্লোর প্রাইসের মতো কৃত্রিম বাজার মূল্য ব্যবস্থা আছে, এমন বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসতে আগ্রহী নয়।'

একই সঙ্গে বাজারে বিনিয়োগযোগ্য পণ্য খুবই কম বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, 'বাজারের প্রশাসনও সমস্যাযুক্ত, কারণ নীতিগুলো ঘন ঘন ও কেস-টু-কেস ভিত্তিতে পরিবর্তিত হয়।'

মূলত বিদেশিরা ২০২০ সালে তাদের শেয়ার বিক্রি করে দিতে শুরু করে। তখন ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা ব্যাপক অবমূল্যায়নের মুখে পড়বে।

মহামারির সময়ে পুঁজিবাজারে ফ্লোর প্রাইস ব্যবস্থা চালুর পর বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাস আরও কমে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। একই সময়ে মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

তদুপরি, বাজারের অবাধ পতন বন্ধে বিএসইসি ২০২০ সালে ফ্লোর প্রাইস চালু করেছিল। অথচ তখন অনেক দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিপরীত পথে হেঁটেছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল এই ব্যবস্থা বাজার স্থিতিশীল রাখতে পারবে না। বরং ফ্লোর প্রাইসের কারণে শেয়ারের লেনদেন কঠিন হয়ে যাবে।

পরে ধীরে ধীরে ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে আবার ফিরিয়ে আনা হয়।

এ বিষয়ে জানতে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামকে ফোন দিলে তিনি তা রিসিভ করেননি। তাই তার মন্তব্য জানতে পারেনি দ্য ডেইলি স্টার।

(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)

Comments