সিনেমার মিষ্টি মেয়ে কবরীর গল্প
মিষ্টি মেয়ে উপাধি একজনই পেয়েছিলেন এদেশের সিনেমায়। তিনি কবরী; সারাহ বেগম কবরী। রোমান্টিক ও সামাজিক সহ সব ধরণের সিনেমায় অভিনয় করে কোটি মানুষের মন জয় করে নেওয়া নায়িকা ছিলেন তিনি। এদেশের সিনেমাকে যারা অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এবং সমৃদ্ধ করেছেন, তাদের মাঝে তিনি অন্যতম।
অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন কবরী। যার মাঝে বেশ কয়েকটি সিনেমাকে কালজয়ী হিসেবেও অভিহিত করা যায়।
১৯৬৪ সালে 'সুতরাং' দিয়ে রূপালি পর্দায় তার যাত্রা শুরু হয়। তার অভিনীত সিনেমার আবেদন এখনো রয়ে গেছে দর্শকদের মাঝে। তার অভিনীত পুরনো দিনের সিনেমার গান আজও বহু মানুষের মুখে মুখে ফেরে। জনপ্রিয়তায় তিনি ছাড়িয়ে গেছেন অনেককে। তার তুলনা তিনি নিজেই ।
আজ ১৭ এপ্রিল কবরীর প্রয়াণ দিবস।
মিনা পাল থেকে হটাত করেই মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি 'সুতরাং' সিনেমা দিয়ে নায়িকা বনে যান। চট্টগ্রামের মিনা পাল ঢাকায় এসে হয়ে যান কবরী। পরিচালক সুভাষ দও তার অভিষেক ঘটান সিনেমায়। তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কবরী নামটি চিরদিনের জন্য এদেশের সিনেমায় বড় একটি আসন গড়ে নেয় সেই থেকে।
একসময় হয়ে যান মিষ্টি মেয়ে। আজও তিনি তাই। সুতরাং সিনেমার একটি গান খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গানটি হচ্ছে--নদী বাঁকা জানি, চাঁদ বাঁকা জানি। মোস্তফা জামান আব্বাসী ও ফেরদৌসি রহমান গানটিতে কণ্ঠ দেন। গানটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা এখনো অটুট রয়েছে।
তার ক্যারিয়ারে যুক্ত হয়েছে অনেক সিনেমা। একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করেছেন এবং মানুষের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। সিনেমাপ্রেমীরা তার সব সিনেমার নাম মনে রাখতে না পারলেও, সেসব সিনেমার গান এখনো মনে রেখেছেন। সেসব গান আজও শোনা যায়।
সুতরাং
সুতরাং সিনেমাটি কবরীর ভাগ্য খুলে দিয়েছিল। এ সিনেমায় অভিনয়ের পর কবরী ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসের অংশ হয়ে যান। যা রয়ে যাবে যুগের পর যুগ ধরে। কয়েকটি উর্দু সিনেমায়ও তিনি অভিনয় করেছেন। কিন্ত সব মিলিয়ে তিনি তার জীবদ্দশায় বাঙালীর ও বাংলা সিনেমার এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
নীল আকাশের নিচে
এটি কবরীর ক্যারিয়ারের অন্যতম সফল একটি সিনেমা। সিনেমাটি যেমন হিট হয়েছিল, পাশাপাশি গানও। এখনো গানগুলো মানুষের মুখে শোনা যায়। নারায়ণ ঘোষ মিতা এ সিনেমার পরিচালক। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় এটি। সিনেমায় কবরীর বিপরীতে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক।তৃষ্ণা চরিত্রে কবরীর সুন্দর ও সাবলীল অভিনয় মানুষের মনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল।
ময়নামতি
কাজী জহির পরিচালিত 'ময়নামতি' সিনেমাটিও কবরীর ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য একটি সিনেমা। এ সিনেমায়ও তার নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। ফুলের মালা পরিয়ে দিলে আমার আপন হাতে… কবরীর লিপে গানটি তুমুল সাড়া ফেলেছিল। এই সিনেমার একটি গান লাখো দর্শককে চোখের জলে ভাসিয়েছে। রূপালি পর্দায় কবরীর যখন বিয়ে হয়ে যায় এবং তাকে যখন পালকিতে করে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়, সেসময় রাজ্জাকের লিপে একটি গান আছে—'অনেক সাধের ময়না অমার বাঁধন ছিঁড়ে যায়।' প্রিয়জনকে কাছে না পাওয়ার বেদনামিশ্রিত এ গানের আবেদন আজও কমেনি।
রংবাজ
কবরীর অন্যতম সফল জুটি রাজ্জাক ছিলেন রংবাজ সিনেমার নায়ক। কবরী ও রাজ্জাক জুটিকে এদেশের দর্শকরা সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। জহিরুল হক খুব নিপুণ ভাবে পরিচালনা করেন রংবাজ। রাজ্জাকের প্রথম অ্যাকশন ছবি এটি। 'সে যে কেন এলো না'.. কবরীর লিপসিঙ্কে গানটি দারুণভাবে সাফল্য পায়। 'হৈ হৈ রঙ্গিলা' গানটিও মানুষ গ্রহণ করে দারুণ ভাবে। কবরীর সুঅভিনয় লাখো দর্শকের মন কেড়ে নেয়।
সুজন সখী
এটি একটি ভালোবাসার সিনেমা। কবরী অভিনীত এই সিনেমার নায়ক ছিলেন ফারুক। সিনেমাটি মুক্তির পর ব্যাপকভাবে দর্শকপ্রিয়তা পায়। মাসের পর মাস চলেছে এটি। এ সিনেমার গানও হিট হয়। আজও একটি গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে—'সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা।'
সারেং বউ
এটি শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বে নির্মিত চলচ্চিত্র। এ সিনেমাটি নির্মাণ করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। উপকূলীয় অঞ্চলের গল্প নিয়ে সারেং বউ সিনেমায় নতুন চরিত্রে একজন সংগ্রামী নারীর ভূমিকায় অভিনয় করে কবরী ভিন্নমাত্রা যোগ করেন। তার সঙ্গে জুটি বাঁধেন ফারুক (সারেং)। এই সিনেমায় কবরীর অভিনয় সব শ্রেণীর দর্শকদের মন ছুয়ে গিয়েছিল। 'ও রে নীল দরিয়া' গানটি এই সিনেমার অলংকার হিসেবে কাজ করেছে।
আবির্ভাব
এই সিনেমার পরিচালনা করেন সুভাষ দও। এটি একটি রোমান্টিক সিনেমা। বহু নাটকীয়তায় ভরা সিনেমা । এ সিনেমা দেখে দর্শকদের চোখের জল ফেলতে হয়েছে। কবরীর অভিনয় কাঁদিয়েছে অনেককে। কবরীর বিপরীতে নায়ক চরিত্রে ছিলেন রাজ্জাক। সিনেমায় দুজনের অভিনীত একটি গান—'কাছে এসো যদি বলো তবে দূরেই কেন থাকো।'
বধূ বিদায়
এটি কবরীর ক্যারিয়ারের আরেকটি সফল সিনেমা। এ সিনেমায় বুলবুল আহমেদ ও কবরী জুটি বাঁধেন। এই সিনেমার একটি গান এতোটাই হিট হয়েছিল যে তা নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে । গানটি হলো-'একটুস খানি দেখো, একখান কথা রাখো, ভালোবেসে একবার তুমি বউ কইয়া ডাকো।' গানটিতে লিপসিঙ্ক করেন কবরী। কাজী জহির এ সিনেমার সফল পরিচালক। মায়া চরিত্রে অভিনয় করেন কবরী। ছায়া চরিত্রে ছিলেন শাবানা।
আরাধনা
কবরী অভিনীত হৃদয় ছোঁয়া সিনেমা আরাধনা। 'আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি'- কবরীর লিপে এই গান আজও বাঙালি নারীর মনে দোলা দেয় । সামাজিক ও বাস্তবধর্মী এই সিনেমার পরিচালক ছিলেন রাজু সিরাজ।
তিতাস একটি নদীর নাম
কবরীর জীবনের মাইল ফলক হয়ে আছে বিখ্যাত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত তিতাস একটি নদীর নাম সিনেমা। এটি তার জীবনের অনন্য একটি সিনেমা । অদ্বৈত মল্লবর্মণের সাড়া জাগানো উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম থেকে সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে।
দেবদাস
সারেং বউ এবং তিতাস একটি নদীর নামের মতো সাহিত্য নির্ভর সিনেমার তালিকায় অপর নামটি দেবদাস। এই চলচ্চিত্র কবরীর নায়িকা খ্যাতিকে আরো উজ্জ্বল করে তুলেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রবল জনপ্রিয় এই উপন্যাস নিয়ে সিনেমা পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম। বাঙালির জন্য আবেগের চরিত্র পার্বতী। এতে অভিনয় করে এখনো সবার হৃদয়ে দাগ কেটে আছেন কবরী। তার বিপরীতে দেবদাস চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বুলবুল আহমেদ। পার্বতী চরিত্রে অভিনয় করে কবরী কাঁদিয়েছেন অসংখ্য দর্শককে এবং মানুষের মন জয় করেছেন সাবলীল অভিনয় দিয়ে ।
মাসুদ রানা
কবরী তার অভিনয় ক্যারিয়ারে গতানুগতিক গল্প ও চরিত্র থেকে বারবার বের হয়ে আসা একজন নায়িকা। প্রতিনিয়ত নিজেকে হালনাগাদ রেখেছেন। তেমনই এক সিনেমা মাসুদ রানা। সেবা প্রকাশনী খ্যাত কাজী আনোয়ার হোসেনের গোয়েন্দা গল্প মাসুদ রানা অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটি পরিচালনা করেন সোহেল রানা। নায়কও ছিলেন তিনি। মাসুদ রানার মাধ্যমে এদেশের সিনেমায় নতুন গল্পের স্বাদ পায় সিনেমাপ্রেমীরা। কবরী নিখুঁত অভিনয় করেন। তার চরিত্রের নাম সবিতা। 'মনেরও রঙে রাঙাবো' – কবরীর লিপে এই গান সেই সময় তুমুল সাড়া ফেলেছিল ।
কবরী অভিনীত আরও অনেক সিনেমা আলোচনায় এসেছে। তার অভিনীত প্রায় সবগুলো সিনেমাই বলতে গেলে দর্শকদের মন ছুয়ে গেছে। বিনিময়,বাহানা,বাঁশরী, দ্বীপ নেভে নাই, দর্পচূর্ণ, মতিমহল, কাঁচকটা হিরা সহ আরো অনেক সিনেমা তার ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করেছে।
কবরী অনেক নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। নায়কদের মাঝে রাজ্জাকের সঙ্গে তার ভাল জুটি গড়ে ওঠে। সুতরাং সিনেমায় অভিনয় করে তার প্রথম উপার্জন এক হাজার এগারো টাকা। তার আগের নাম ছিল মিনা পাল। রূপালি পর্দায় নাম লেখানোর পর তিনি হয়ে যান বাঙালির মিষ্টি মেয়ে কবরী। পরিচালক হিসেবে নাম লেখান আয়না সিনেমা দিয়ে। সর্বশেষ পরিচালনা করেন এই তুমি সেই তুমি, যা শেষ করার আগেই মারা যান তিনি।
আপাদমস্তক সিনেমার পরিপূর্ণ শিল্পী কবরী ছিলেন একজন সফল মানুষ, সফল শিল্পী। সেই সঙ্গে রাজনীতিবিদ হিসেবেও সংসদ সদস্য হয়েছিলেন একবার। তবে, তার মনে প্রাণে ছিল সিনেমা এবং সিনেমা । জীবদ্দশায় তিনি লিখে গেছেন আত্মকথা। বইয়ের নাম স্মৃতিটুকু থাক। এই নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করেও স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি ।
১৭ এপ্রিল মিষ্টি মেয়ে খ্যাত নায়িকা কবরী না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। মিষ্টি মেয়ে কবরী নেই, কিন্ত তার স্মৃতিটুকু রয়ে গেছে ।
Comments