‘জনতার নায়ক’ মান্না

টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় এসে রূপালি পর্দার নায়ক হয়েছিলেন মান্না। পেয়েছিলেন সফলতা। মাত্র ২৪ বছরে প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বদলে দিয়েছিলেন ক্যারিয়ার। গড়েছিলেন শীর্ষ অবস্থান।
১৯৮৪ সালে এফডিসির নতুন মুখের প্রতিযোগিতা দিয়ে ঢালিউডে মান্নার আগমন ঘটেছিল। এরপর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন 'জনতার নায়ক'। নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত—সর্বস্তরে ছিল তার বিপুল জনপ্রিয়তা।
একক নায়ক হিসেবে মান্নার ক্যারিয়ার ছিল খুব উজ্জ্বল। শুরুতে একক নায়ক হিসেবে সুযোগ না পেলেও একসময় মান্নার নামেই সিনেমা চলত। শুধু কি তাই? তাকে কেন্দ্র করে গল্পও লেখা হতো। এরকম রেকর্ড কম নায়কের ভাগ্যে জুটেছে।
প্রতিবাদী চরিত্রে নায়ক মান্না ছিলেন অতুলনীয়। অনেকেই বলতেন, প্রতিবাদী চরিত্রের নায়ক মান্না। প্রতিবাদী চরিত্রে দুর্দান্তভাবে মানিয়ে যেতেন। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষেরাও তাকে খুব পছন্দ করতেন। একেবারে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত—সবাই ছিলেন তার সিনেমার দর্শক।

মান্না অভিনীত অনেক সিনেমা ব্যবসাসফল হয়েছে। আজও তার সিনেমার বহু সংলাপ মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। আইয়ুব বাচ্চু ও জেমস তার সিনেমায় গান করেছিলেন। সেই গানগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
মান্নার স্বপ্নের নায়ক ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। একটি টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকারে এই কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন। টাঙ্গাইল থেকে বাসে করে ঢাকায় আসতেন সিনেমা দেখতে। আবার সিনেমা দেখা শেষ করে ফিরে যেতেন নিজ এলাকায়। এই গল্প নায়ক হওয়ার আগেকার।
একক নায়ক হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন 'কাশেম মালার প্রেম' সিনেমায়। তার নায়িকা ছিলেন চম্পা। নায়ক হিসেবে মান্নাকে বেশ পরিচিতি এনে দিয়েছিল এই সিনেমা। অবশ্য, তার অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম সিনেমা 'পাগলী'। পরিচালনা করেন কাজী হায়াৎ। তাকে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ দেন নায়করাজ রাজ্জাক। সিনেমার নাম 'তওবা'।
কাজী হায়াৎ অনেকগুলো সিনেমা পরিচালনা করেছিলেন নায়ক মান্নাকে নিয়ে। 'দাঙ্গা' তার মধ্যে একটি। সিনেমা ঢাকাসহ সারাদেশের প্রেক্ষাগৃহে ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল। এই সিনেমায় তিনি ওসির চরিত্রে অভিনয় করেন।
কাজী হায়াত পরিচালিত 'তেজি' সিনেমা সুপারহিট হওয়ার পর মান্নার জীবনের গল্প বদলে যেতে শুরু করে। ঢালিউডে শুরু হয় মান্নার অধ্যায়। এই ধারাবাহিকতা তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিল। ঢালিউডে মান্না নতুন একটি যুগের শুভ সূচনা করেছিলেন।

নায়ক হিসেবে মান্না অভিনীত 'আম্মাজান' সিনেমা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়। এখনো দর্শকরা এই সিনেমার কথা বলেন এবং তার অভিনয়ের প্রশংসাও করেন। এই সিনেমার 'আম্মাজান আম্মাজান' গানটি অনেকের মুখে মুখে ফেরে।
আম্মাজান সিনেমায় নামভূমিকায় অভিনয় করেন ষাটের দশকের বিখ্যাত নায়িকা শবনম। তিনি বলেন, আম্মাজান সিনেমা করতে গিয়ে মান্নার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। মাঝে মাঝে সেসব কথা মনে পড়ে। সত্যি কথা বলতে এই সিনেমা করেছি বলে এখনো কোথাও গেলে মানুষ আমাকে আম্মাজান বলে ডাকেন। আম্মাজান অনেক বড় রেকর্ড গড়েছে।
'আসলাম ভাই' সিনেমায় আসলাম চরিত্রে অভিনয় করেন মান্না। 'মোঘল-এ-আজম' সিনেমায় তিনি সেলিম চরিত্রে অভিনয় করেন। 'সন্ত্রাসী মুন্না' সিনেমায় অভিনয় করেন মুন্না চরিত্রে। অ্যাকশন, রোমান্টিক, পোশাকি, সামাজিক—সব ধরনের সিনেমা তিনি করেছেন। তবে, প্রতিবাদী চরিত্রগুলো তাকে বেশি জনপ্রিয়তা দিয়েছে।
তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমা—ত্রাস, দাঙ্গা, আম্মাজান, তেজি, শান্ত কেন মাস্তান, সিপাহি, লাল বাদশা, মায়ের মর্যাদা, লুটতরাজ, দুই বধূ এক স্বামী, পিতা মাতার আমানত, বীর সৈনিক, মিনিস্টার, কাশেম মালার প্রেম, স্বামী –স্ত্রীর যুদ্ধ, অমর, মনের সাথে যুদ্ধ, ক্ষমা, প্রেম দিওয়ানা, দেশদ্রোহী... ইত্যাদি।

নায়ক থেকে প্রযোজকও হয়েছিলেন মান্না। গড়ে তুলেছিলেন কৃতাঞ্জলি চলচ্চিত্র। এই হাউস থেকে বেশ কয়েকটি সিনেমা প্রযোজনা করেছেন।
নায়িকা পূর্ণিমা তার বিপরীতে একাধিক সিনেমা করেছেন। তিনি বলেন, মান্না ভাই আপাদমস্তক সিনেমার মানুষ ছিলেন। সিনেমা ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান, সবকিছু। দর্শকরা তাকে খুব পছন্দ করতেন। অনেক ব্যবসাসফল সিনেমা তিনি উপহার দিয়ে গেছেন।
মান্নার স্ত্রী শেলী মান্না ও একমাত্র পুত্র সিয়াম ইলতেমাশ।
২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি মারা যান। ওইদিন এফডিসিতে 'জনতার নায়ক'-কে শেষবারের মতোন দেখতে ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ। জনতার ঢল নিয়ন্ত্রণে পুলিশও মোতায়েন করা হয় সেদিন।
Comments