‘আমার তো তহবিল খালি হয়ে যাচ্ছে’

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যুক্তি দিতে গিয়ে সরকার বলেছে, বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। বাস্তবে বিশ্ববাজারে দাম এখন কমতির দিকে। সরকার বলে, জ্বালানি তেলে বিপুল অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি দেওয়া হয়। বাস্তবে জ্বালানি তেল থেকে সরকার ৩৭ শতাংশ শুল্ক-কর পায়। অর্থাৎ সরকার আমদানিকৃত তেলে ৩৭ শতাংশ শুল্ক-কর ধরে দাম নির্ধারণ করে, তারপর বলে ভর্তুকি দেওয়া হলো। অথচ শুল্ক-কর বাদ দিলে বা কমালে বিপিসির লোকসান বা ভর্তুকির প্রসঙ্গ আসত না। বিশ্ববাজারে ২০১৪ সালের দিকে তেলের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। তখন দেশে দাম কমানো হয়নি। বিপিসি বিপুল পরিমাণ লাভ করেছে। সেই অর্থ সরকার নিয়ে ব্যয় করেছে। এখন বলছে, দাম না বাড়ালে তহবিল খালি হয়ে যাবে।
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির যুক্তি দিতে গিয়ে সরকার বলেছে, বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছে। বাস্তবে বিশ্ববাজারে দাম এখন কমতির দিকে। সরকার বলে, জ্বালানি তেলে বিপুল অঙ্কের অর্থ ভর্তুকি দেওয়া হয়। বাস্তবে জ্বালানি তেল থেকে সরকার ৩৭ শতাংশ শুল্ক-কর পায়। অর্থাৎ সরকার আমদানিকৃত তেলে ৩৭ শতাংশ শুল্ক-কর ধরে দাম নির্ধারণ করে, তারপর বলে ভর্তুকি দেওয়া হলো। অথচ শুল্ক-কর বাদ দিলে বা কমালে বিপিসির লোকসান বা ভর্তুকির প্রসঙ্গ আসত না। বিশ্ববাজারে ২০১৪ সালের দিকে তেলের দাম অনেক কমে গিয়েছিল। তখন দেশে দাম কমানো হয়নি। বিপিসি বিপুল পরিমাণ লাভ করেছে। সেই অর্থ সরকার নিয়ে ব্যয় করেছে। এখন বলছে, দাম না বাড়ালে তহবিল খালি হয়ে যাবে।

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সঙ্গে।

দ্য ডেইলি স্টার: আপনারা বলছেন দাম সমন্বয় করা হলো। বিশ্ববাজারে যখন তেলের দাম কমে তখন আপনারা কমান না। দাম যখন বাড়ে তখন আপনারা বাড়ান। কেন?

জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ: দাম যখন কমবে তখন আমরা অবশ্যই কমাব। দামটা কত, সেটা একটা প্রশ্ন। যখন ১৭০ ডলার ছিল ডিজেলের দাম, তখন কিন্তু আমরা দামটা সমন্বয় করিনি। আমি অপেক্ষায় ছিলাম পরিস্থিতি হয়তো স্বাভাবিক হয়ে আসবে। (তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি) ৭৯ ডলারের ওপরে গেলেই বিপিসি আস্তে আস্তে লোকসানের দিকে যেতে থাকে। কিন্তু দামটা ১৭০ ডলার হয়ে যায়। বিপিসি তখন আমাকে বলল, 'স্যার, আমরা দামটা সমন্বয় করতে চাই।' আমি যদি তখন দামটা সমন্বয় করতাম, তাহলে এই ৮০ টাকার ডিজেল হতো ১৬০ টাকা। আমি বললাম, অপেক্ষা করেন। আমি বললাম, সমন্বয় করেন। এই সমন্বয় করতে গিয়ে বিপিসি অলরেডি ৮ হাজার কোটি টাকা নিজস্ব অর্থ খরচ করে ফেলছে।

ডেইলি স্টার: নিজস্ব অর্থ মানে? বিপিসি যে লাভ করেছিল সেই টাকা?

নসরুল হামিদ: বিপিসি আগে যে লাভ করেছে, সেগুলো বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে। দাম যখন কমেছে তখনো বিপিসিকে ভর্তুকির টাকা দিতে হয়েছে। ট্যাক্স ও ভ্যাট অ্যাডজাস্ট করতে হয়েছে। সেই ট্যাক্স ও ভ্যাট অ্যাডজাস্টমেন্ট বাদেও আমাদের কাছে ২০ থেকে ২১ হাজার কোটি টাকা পায় (সরকার)।

আমাদের বিষয়টা হলো, দাম কতটুকু কমলে পরে আমরা কতটুকু কমাব। বিপিসির কস্টিং হলো ৭৯ ডলার। এটা মাথায় রাখতে হবে। আমরা সবচেয়ে বেশি ইমপোর্ট করি ডিজেল। বাকিটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। আমাদের ৯০ পারসেন্ট ডিজেল ব্যবহৃত হয় যানবাহনে, সেচ এবং অন্যান্য জায়গায়। সেচে সরকার বলেছে ভর্তুকি দেবে, প্রাইস অ্যাডজাস্ট করে দেবে। কিন্তু যানবাহনে আমি অ্যাডজাস্টমেন্ট করব না। আমরা বসে ছিলাম। তারপর দেখলাম ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। তার মানে কী—আরও লস আসছে। তখন আমার প্রস্তাব ছিল ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া। বিপিসিকে যে ট্যাক্সটা ধরা হয় এবং ইমপোর্টে যে ভ্যাট ও ট্যাক্সটা ধরা হয়, সেটা কমিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিই আমি।

ডেইলি স্টার: জ্বালানি তেল থেকে সরকার তো প্রায় ৩৭ শতাংশ শুল্ক-কর পায়। সেটা কিছু কমালে তো দাম বাড়াতে হতো না।

নসরুল হামিদ: আমরা সরকারকে কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সরকার বলল, আমি শুল্ক-কর কমাব না। কারণ এই টাকা তো অন্য খাতে খরচ করতে হয়। এদিকে আমার তো তহবিল খালি হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম যে, ইন্ডিয়াতে ১১৪ টাকা হয়ে গেছে পার লিটার ডিজেল। দুবাইয়ে এই মুহূর্তে দাম হলো ১২২ টাকা। আমার হলো ৮০ টাকা। আমি বললাম, বিদ্যুতে ডিজেল ব্যবহার করব না। হাজার মেগাওয়াট কাটঅফ করলাম। তারপরও দেখলাম ডিজেলের চাহিদা কমেনি। তার মানে ভারতের সঙ্গে যদি আমাদের ৫০ টাকা, ৮০ টাকা ডিফারেন্স থাকে, তাহলের বিশাল অঙ্কের তেল বর্ডার দিয়ে চলে যাওয়ার যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ডেইলি স্টার: তার মানে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে ডিজেল সাশ্রয়ের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সেটা আসলে ফলপ্রসু হয়নি?

নসরুল হামিদ: আমরা আমাদের সেক্টরে সাশ্রয় করছি, কিন্তু যানবাহন খাতে তো সাশ্রয় হয়নি। ৯০ পারসেন্ট ডিজেল ব্যবহার হয় জাহাজে, যানবাহনে আর সেচে। সেচেরটা না হয় ধরে নিলাম যে, এটা ফিক্সড আছে। সেচ যখন লাগবে তখন ব্যবহার করবে। সেখানে সরকার একটা ভর্তুকি দেয়। কিন্তু গত ১ মাসে বারবার আমি বলে এসেছি যে, আপনারা একটু সাশ্রয়ী হন। আপনারা অফিস-আদালতে গাড়ি একটু কম ব্যবহার করুন। এক গাড়িতে ৪ জন মিলে যাতায়াত করুন, যে জিনিসটা উন্নত বিশ্ব করেছে। ইউকে বলছে, বিদ্যুৎ ব্যবহার কমিয়ে দিন। গ্যাস (ব্যবহার) কমিয়ে দেন।

ডেইলি স্টার: এই যে আপনি বিদ্যুৎ-জ্বালানি ব্যবহার কমানোর কথা বললেন, একটা গাড়িতে ১ জন না গিয়ে ৪ জন যাওয়ার কথা বললেন—এগুলো কি আপনারা সরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন? সরকারি কর্মকর্তা যারা একেকজন ১টি বা একাধিক বড় বড় গাড়ি ব্যবহার করেন,তারা কি গাড়ি ব্যবহার বাদ দিয়েছেন?

নসরুল হামিদ: আমি তো আর পুরো সরকারের দায়িত্বে না। আমি আমার সেক্টরের কথা বলতে পারি। আমার সেক্টরে আমি চেষ্টা করছি গাড়ির ব্যবহার কমানো যায় কি না। কিছুদিন আগে দেখলাম একজন গাড়ি নিয়ে বাজারে গেছে, আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু নিজেরা যদি সাবধান না হই, মন্ত্রী একা কতটুকু করতে পারবে? প্রতি গাড়িতে সে তো পাহারা দিতে পারবে না। সবাইকে এটা পাহারা দিতে হবে। জার্মানি নিজেরাই ২০ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার সাশ্রয় করে ফেলেছে। বলা হচ্ছে, আগামী উইন্টারে তারা ৪০ শতাংশ গ্যাস পাবে না।

কেউ কথা শোনে না। আমাদের কথা হলো, আমরা যে প্রাইসটা এখন অ্যাডজাস্ট করছি তা আগের তুলনায় কম। ডিজেলের প্রাইস ১১৪ টাকা করেছি, ভারতের সঙ্গে একটা সমন্বয় রাখার জন্য।

ডেইলি স্টার: দামের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবহনের যে খরচ বাড়বে? জিনিসপত্রের যে দাম বাড়বে?

নসরুল হামিদ: পরিবহন মালিক সমিতির সঙ্গে ১ মাস আগে আমি বসছিলাম। বিআরটিএর একটা কমিটি আছে প্রাইস ফিক্স (ভাড়া নির্ধারণ) করার জন্য। আমরা তাদের (মালিক সমিতি) দেখালাম, যেহেতু ডিজেলে লিটারপ্রতি ৩৪ টাকা বাড়ছে, এতে আমাদের ২৬ পয়সা বাড়ে যাত্রীপ্রতি।

আমার যুক্তিটা হলো ওখানেই। বিআরটিএ যেহেতু তার ফর্মুলা অনুসারে এটা নির্ধারণ করে, এক্ষেত্রে পরিবহন মালিকরা যদি ৫-১০ টাকা বাড়ানোর চিন্তা করে তাহলে সেটা অযৌক্তিক হবে।

আমার সঙ্গে নৌ-পরিবহন মালিক সমিতির কথা হয়েছে। তারা বলেছে, বিআইডব্লিউটিএ যেভাবে বলবে, সেভাবে আমরা কাজ করব। এখন হঠাৎ করে আজকে দেখলাম সব যানবাহন বন্ধ করে দিচ্ছে। দিস ইজ টু ব্যাড। এভাবে ব্ল্যাকমেলিং করা উচিত না বলে আমি মনে করি।

বিষয়টা নিয়ে আমি সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, আজ বিকেলে তিনি বসবেন।

ডেইলি স্টার: দাম বাড়ানোর যে প্রক্রিয়া—এই যে আপনারা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সিদ্ধান্ত নিয়ে দাম বাড়ান, গণশুনানি বা আইনিভাবে যা করা দরকার, যে প্রক্রিয়ায় যাওয়া দরকার, সেটা করা হয় না। বিশেষ করে ভোক্তা পর্যায়ে আলোচনা করা হয় না। এটা কি ঠিক?

নসরুল হামিদ: এই পরিস্থিতিতে কেবল লিকুইড ফুয়েল মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হয়েছে।

ডেইলি স্টার: কিন্তু আইন অনুযায়ী দাম বাড়ানো বা সমন্বয়ের দায়িত্ব তো বিইআরসির। মন্ত্রণালয় থেকে কোনো আলোচনা ছাড়া আপনারা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এতে আইনের ব্যত্যয় হচ্ছে না?

নসরুল হামিদ: এক যুক্তিতে এতে আইনের ব্যত্যয় হয়। আরেক যুক্তিতে হয় না।

ডেইলি স্টার: আপনি কী মনে করেন? এ জন্য শুনানি বা ভোক্তা পর্যায়ে আলোচনা করা দরকার ছিল?

নসরুল হামিদ: কয়েকবার (দাম) বাড়ানোর প্রয়োজন হয়, কারণ এখন মার্কেট ভোলাটাইল। এ পর্যায়ে প্রতিবার শুনানি করতে গেলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ৯০ দিনের সময় দিয়ে, শুনানি করে দাম বাড়াতে গেলে তো সমস্যা হয়ে যাবে।

ডেইলি স্টার: মাঝে যখন তেলের দাম ৪০-৫০ ডলারে চলে এলো, তখন দাম কমানো নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছিল। তখন কিন্তু আপনারা দাম কমাননি।

নসরুল হামিদ: ওই যে আমি বললাম, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা ছিল। (সরকার) আমাদের বলছে তোমরা যে টাকা নিয়েছ, সেটা দেওয়ার ব্যবস্থা করো।

আমি বিপিসিকে বলে দিয়েছি এবং সরকারকেও বলছি, আমরা প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্টে যাব। আমি প্রাইস বাড়াচ্ছি কারণ আমার দেউলিয়াত্ব থেকে আমি বাঁচতে চাই। আমাকে তো ইমপোর্ট করতে হবে, সাপ্লাই দিতে হবে।

ডেইলি স্টার: তাহলে কি আমরা এই নীতিতে এলাম যে, দাম এখন ৯০ ডলার আছে, ৭০ ডলারে এলে দাম আবার কমাব?

নসরুল হামিদ: অবশ্যই কমাব।

Comments