বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে, তবুও লোডশেডিং

‘দেশের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে যতটা জ্বালানি দরকার, সেই পরিমাণে সরকার কখনোই আমদানি করতে পারেনি।’
ছবি: স্টার

বর্ষা মৌসুম আসার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেলেও গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি এবং রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।

বর্ষাকালে বিদ্যুতের চাহিদা নেমে এসেছে প্রায় ১৫ হাজার মেগাওয়াটে, যেখানে নিয়মিত চাহিদা ১৭ হাজার মেগাওয়াট। অথচ, ২৬ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও এই কম চাহিদার সময়েও পুরোটা সরবরাহ করতে পারছে না পিডিবি।

উৎপাদন তথ্য থেকে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে পিডিবি সরবরাহ করছে প্রায় ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

জ্বালানির ঘাটতি এবং স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অন্তত ১০ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে আছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ১৩২ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এবং ৪ হাজার ৯৭১ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র জ্বালানির ঘাটতির জন্য বসে আছেন।

পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, ৪ হাজার ৯৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৩ হাজার ১৫২ মেগাওয়াট অলস বসে আছে গ্যাসের অভাবে।

পিডিবি যদি তাদের গ্যাসচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে চায়, তাহলে প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার ৯৫৯ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন হবে।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুসারে, ঘূর্ণিঝড় রিমাল দুটি ভাসমান স্টোরেজ ও রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) একটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করায় গত এক মাস ধরে পিডিবি প্রতিদিন গ্যাস পাচ্ছে ৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট করে।

আগামী ১৫ জুলাইয়ের আগে ক্ষতিগ্রস্ত এফএসআরইউটি চালু হবে না।

ফলে, ৭০টি গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ৩৬টিকে অলস বসিয়ে রাখতে হচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড় রিমালের আগে পিডিবিকে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ না পেয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পরে পিডিবি। কিন্তু সেগুলোও তাদের সক্ষমতার চেয়ে কম বিদ্যুৎ উৎপন্ন করছে।

তিনটি প্রধান কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে রামপাল ও এসএস পাওয়ার সর্বোচ্চ তাদের অর্ধেক সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে। সম্পূর্ণ সক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে কেবল পায়রা।

এ ছাড়া, গত ২৫ জুন ভারতের ঝাড়খণ্ডে আদানির ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল মঙ্গলবার এটি আবার চালু হয়েছে।

সার্বিক পরিস্থিতির কারণে ব্যয়বহুল ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে হয় পিডিবিকে। এ বিষয়ে অবগত কর্মকর্তারা জানান, এর ফলে বিদ্যুৎ উত্পাদন ব্যয় অনেকে বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের যে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে, তাতে তো দেশে আর কোনো লোডশেডিং থাকার কথা না। কিন্তু আমরা সেটা হতে দেখিনি।'

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে। আরইবি দেশের ৭০ শতাংশেরও বেশি গ্রাহকের মাঝে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, প্রধানত গ্রামীণ এলাকায়।

তবে, পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলে জানিয়েছেন পিডিবি কর্মকর্তারা।

পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন বলেন, 'আবহাওয়া আমাদের অনুকূলে আছে (চাহিদা কমে যাওয়ায়)। আশা করি পরিস্থিতির আর অবনতি হবে না।'

বাংলাদেশ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলমের ভাষ্য, সরকার সবসময় প্রকৃত পরিস্থিতি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।

তিনি বলেন, 'তাদের বরং সংকট স্বীকার করা উচিত এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা উচিত।'

অধ্যাপক ইজাজ হোসেন জানান, গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি এখন সবচেয়ে খারাপ। এর পাশাপাশি অপ্রত্যাশিত নানা পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, 'বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে আমাদের উচ্চমূল্যের ফার্নেস অয়েল বা ডিজেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। এর ফলে ডলার সংকটের মধ্যে উৎপাদন খরচ আরও বেড়ে গেছে। উচ্চমূল্যের জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো প্রতিস্থাপন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের জন্য আমাদের কাছে পর্যাপ্ত সময় ছিল, কিন্তু সেটা করা হয়নি। সার্বিক পরিস্থিতি আমাদের আরও নিবিড়ভাবে পুনর্বিবেচনা করা উচিত।'

এম শামসুল আলম বলেন, 'দেশের চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎকেন্দ্রে যতটা জ্বালানি দরকার, সেই পরিমাণে সরকার কখনোই আমদানি করতে পারেনি।'

তিনি বলেন, 'তারা সঠিক পরিকল্পনা বা চাহিদা বিশ্লেষণ ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়িয়েছে। অথচ, সঠিক পরিকল্পনা বা চাহিদা বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি ছিল। আমরা কোনো আদর্শ নীতির অনুসরণ করিনি, এমনকি আমাদেরও এ সংক্রান্ত কোনো নীতিমালাই নেই।'

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, 'একসঙ্গে এতগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা অস্বাভাবিক। এমনও সময় গেছে যখন ওভারলোডেড বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রাখা হয়েছে এবং চাহিদা মেটাতে নির্ধারিত রক্ষণাবেক্ষণ স্থগিত রাখা হয়েছে।'

বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পূর্বনির্ধারিত এবং একটির পর একটিতে হওয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বিদ্যুতের চাহিদা বেশি থাকলে সেই সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা উচিৎ না। এই মুহুর্তে, যখন বিদ্যুৎ দরকার, তখন বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা একটা অজুহাত মাত্র।'

'আমরা আসলে আমদানি করা জ্বালানির বিল পরিশোধ করতে পারিনি। ডলার সংকটের কারণে বিদ্যুৎ কেনার টাকা দিতে পারিনি। আমরা শুধু দাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি এবং বন্ডের মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধ করেছি। আগামী বছরগুলোতে যখন এসব ঋণ পরিশোধ করতে হবে তখন কী অবস্থা হবে, ভাবতেও ভয় হচ্ছে।'

Comments