হরিণঘাটা বন

কেওড়া সংগ্রহের নামে বৃক্ষনিধন

২০১৫ সালে বনাঞ্চলটি পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলে এখানে পর্যটক বাড়তে থাকে। পায়ে হেঁটে বনটির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পর্যটকদের সুবিধার্থে বনের ভেতর প্রায় দুই কিলোমিটার ওয়াকওয়ে তৈরি করা হয়।
হরিণঘাটা বন
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনে চলছে বৃক্ষনিধন। ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনে কেওড়া ফল সংগ্রহের নামে অবাধে চলছে বৃক্ষনিধন। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে প্রায় ২০০ হেক্টর বা প্রায় ৫ হাজার একরের এই বন কেওড়া, গেওয়া, সুন্দরী আর ঝাউ গাছে পরিপূর্ণ। তবে কেওড়া গাছে প্রচুর ফল থাকায় স্থানীয় একটি চক্র সেগুলো সংগ্রহের পাশাপাশি গাছও কেটে নিচ্ছে।

কেওড়ার ফল সংগ্রহের নামে বন উজাড় বন্ধসহ বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণের দাবিতে স্থানীয় পরিবেশবাদীরা মানববন্ধনও করেন।

পাথরঘাটা বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩-২০১৬ সালে উপজেলা শহর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের তীরে প্রায় ২০০ হেক্টর এলাকায় বন বিভাগ বিশেষ কর্মসূচির আওতায় গাছ রোপণ করে।

এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে বনের পরিধি ও ঘনত্ব। দৃষ্টিনন্দন এ বনে কেওড়া গাছের সংখ্যাই বেশি বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।

২০১৫ সালে বনাঞ্চলটি পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলে এখানে পর্যটক বাড়তে থাকে। পায়ে হেঁটে বনটির সৌন্দর্য উপভোগের জন্য পর্যটকদের সুবিধার্থে বনের ভেতর প্রায় দুই কিলোমিটার ওয়াকওয়ে তৈরি করা হয়।

কেওড়া গাছে এ মৌসুমে প্রচুর ফল ধরেছে। বীজ সংগ্রহের জন্য বনকর্মীরা এ ফল সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি স্থানীয় কিছু মানুষ বনে ঢুকে এই সুস্বাদু ফল সংগ্রহ করেন। বন বিভাগ এতে আপত্তি না করলেও ফল সংগ্রহের নামে এক শ্রেণির মানুষ গাছ কাটতে শুরু করে।

সম্প্রতি হরিণঘাটা বনাঞ্চলে গিয়ে দেখা গেছে, গভীর বনে ২০-২৫ জনের একটি দল কেওড়া ফল সংগ্রহ করছে। ফল সংগ্রহের সময় তারা গাছ ও বড় বড় ডাল কেটে ফেলছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

হরিণঘাটা বন
কেওড়া সংগ্রহের নামে অনেকে বনের গাছ কেটে পাচার করছেন বলে অভিযোগ আছে। ছবি: সোহরাব হোসেন/স্টার

তাদের একজন আবদুল হক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাগরে ও নদীতে মাছ ধরার পাশাপাশি কেওড়া ফল সংগ্রহ ও বিক্রি করে জীবন চালাই। বন বিভাগকে টাকা দিয়ে কেওড়া সংগ্রহের মৌখিক অনুমতি নিয়েছি।'

তবে কত টাকার বিনিময়ে অনুমতি নিয়েছেন তা তিনি বলতে রাজি হননি।

সে সময় বেশ কয়েকটি কেটে ফেলা গাছের গুঁড়ি সেখানে পড়ে থাকতে দেখা যায়। গাছ কাটার বিষয়টি অস্বীকার করে আবদুল হক বলেন, 'আমরা শুধু কেওড়া ফল সংগ্রহ করি, কারা গাছ কেটেছে আমাদের জানা নাই।'

হরিণঘাটা এলাকার জেলে নুরুল আমিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মৌসুম শুরুর পর থেকে কেওড়া সংগ্রহের নামে অনেকে বনের গাছ কেটে পাচার করছেন।'

স্থানীয়দের অভিযোগ, শুধু হরিণঘাটা বনেই নয় উপজেলার টেংরা, মাঝের চর, চর লাঠিমারা, জ্ঞানপাড়া ও বিহঙ্গ দ্বীপের সংরক্ষিত বনের গাছ কাটা হচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে আরও দুই মাস এভাবে ফল সংগ্রহের পাশাপাশি গাছও কাটা চলবে।

বন উজাড় বন্ধ এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় পরিবেশবাদীরা।

'সুন্দরবনের মতো উপকূলবর্তী বনাঞ্চল ঝড়-বন্যা থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে' জানিয়ে পরিবেশ গবেষক ও সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম খোকন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কিছু অসাধু ব্যক্তি কেওড়া ফল সংগ্রহের পাশাপাশি গাছও কাটছে।'

তিনি মনে করেন, 'এভাবে বন ধ্বংস করা হলে অদূর ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বাড়বে এবং মানুষজন আরও হুমকিতে পড়বে।'

বনবিভাগ পাথরঘাটা রেঞ্জের বন কর্মকর্তা ও হরিণঘাটা এলাকার বিট কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'লোকবল সংকটের কারণে কাঠ পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনতে পারছি না। সংরক্ষিত বনে কেওড়া ফল সংগ্রহের জন্য আমরা কাউকে অনুমতি দিইনি। গাছ কাটার অভিযোগ পাওয়ার পর বনের ভেতর বাইরের কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না। এ ধরনের নির্দেশনা দিয়ে প্রতিটি বিট অফিসে দাপ্তরিক চিঠি দেওয়া হয়েছে।'

গাছ কাটার অভিযোগে চার জনের বিরুদ্ধে বন আইনে মামলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বরগুনা জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

কেওড়া ফলের গুরুত্ব সম্পর্কে পটুয়াখালী সদর উপজেলা বন কর্মকর্তা নয়ন মিস্ত্রি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কেওড়ার ফল টক বা অম্ল স্বাদযুক্ত হওয়ায় তা লবণ দিয়ে খাওয়া যায়। অনেকে কেওড়া ফলের আচার ও চাটনি বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান। এ ফলটি পচে গেলে চাষিরা মাছের খাবার হিসেবেও ব্যবহার করে থাকেন।'

তিনি জানান, কেওড়ার পাতা-ফল হরিণ ও বানরের প্রিয় খাবার। একটি ফলে বীজ থাকে ১০০-১২৫টি। এগুলো থেকে বন বিভাগ ও অন্যান্য নার্সারিতে চারা উৎপাদন করা হয়।

Comments