সাহসী-সুদর্শন-প্রেমিক দুধরাজ

বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি দুধরাজ। ছবি: মোছাব্বের হোসেন রিবন

প্রেমিক হতে হলে নাকি সাহসী হতে হয়! কথাটি যে কেবল মনুষ্যকূলের জন্য প্রযোজ্য, তা নয়। অন্য অনেক প্রাণী কিংবা পাখির ক্ষেত্রেও বাক্যটি সমানভাবে প্রায়োগিক।

পক্ষীকূলের মধ্যে দুধরাজ সেই প্রজাতির পুরুষ পাখি, যারা একইসঙ্গে সুদর্শন, সাহসী, বুদ্ধিমান ও তুখোড় প্রেমিক।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশে কমবেশি ৭২২ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর ভেতর সুন্দর পাখির সংখ্যা অনেক। সেই সুন্দর পাখিদের মধ্যে দুধরাজের অবস্থান বিশেষ। এদের গায়ের রঙ, ওড়ার ঢঙ, বাসা তৈরি—এমন সবকিছুতেই আছে শিল্প ও নান্দনিকতার ছোঁয়া।

ছবি: মোছাব্বের হোসেন রিবন

বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতিতে প্রজাপতি ছাড়া আরেকটি 'উড়ন্ত সৌন্দর্য' হলো পাখি। নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মাও যেমন বলতেন, শিশুমনে পাখি যে পরিমাণ বিস্ময়ের উদ্রেক করে, তার সমতুল্য আর কিছুই নেই।

'গহন কোন বনের ধারে' গ্রন্থে এই নিসর্গবিদ বলেন, 'ফুল ও পাখির উদয় পৃথিবীতে বলা চলে এক সঙ্গে, প্রায় ১০-১২ কোটি বছর আগে। সৌন্দর্যে, বৈচিত্র্যে উভয়ই সমতুল- তবু পাখি ছোটদের এত মন ভোলায় কেন?'

এই অঞ্চলের বিভিন্ন লোকছড়া ও লোকসাহিত্যেও হীরামন, চন্দনা, হুদহুদ ও শুকসারীর মতো বিভিন্ন পাখি চরিত্রের দেখা মেলে। আবার ছেলেবেলায় পড়া 'আয়রে পাখি লেজঝোলা/খোকন দিয়ে কর খেলা/খাবিদাবি কলকলাবি/খোকনরে মোর ঘুম পাড়াবি' ছড়াটিও দুধরাজের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। কারণ, দুধরাজ 'লেজঝোলা' নামেও পরিচিত।

ছবি: মোছাব্বের হোসেন রিবন

দুধরাজের সুদৃশ্য লম্বা লেজ দুটি এদের শরীরের তুলনায় চার–পাঁচ গুণ বড়। বাতাসে এই সুদৃশ্য লেজ-ফিতা দোলার সময় নান্দনিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়।

পাখিবিশারদ শরীফ খান জানাচ্ছেন, দুঃসাহসী পুরুষ পাখি দুধরাজ বাসার চারপাশ কড়া পাহারায় রাখে। বাসার ত্রিসীমানায় বেজি-বনবিড়াল, পোষা কুকুর-বিড়াল, গুইসাপ-বিষধর সাপসহ শিকারি পাখিরা এলেই কর্কশ ডাক ছেড়ে আক্রমণ করে। আক্রমণের গতি ও আকস্মিকতায় শত্রুরা ভড়কে যায়। এই সুবিধা নেওয়ার জন্যই দুধরাজের বাসার কাছাকাছি বাসা করে কমলা দোয়েল, হলদে বউ, চশমা পাখি, নাচুনে, ভ্যাদাটুনি, বুলবুলিসহ বিভিন্ন পাখিরা।

দুধরানি। ছবি: মোছাব্বের হোসেন রিবন

এই প্রজাতির মেয়ে পাখি হলো দুধরানি। দুধরানির যেকোনো বিপদে দুধরাজ অস্থির হয়ে আহাজারি করতে শুরু করে। ডিমে তা দিতে দিতে ক্লান্ত বা ক্ষুধার্ত হয়ে দুধরানি যখন বাসা ছেড়ে উড়াল দেয়, তখন দুধরাজ ডিমে বসে। তায়ে সুবিধার জন্য ঠোঁট দিয়ে ডিম উল্টেপাল্টে দেয়।

বাসা করার জন্য ছায়াঘন জায়গা পছন্দ দুধরাজের। বেশি পছন্দ বাঁশঝাড়, আম কিংবা কাঁঠাল গাছের ঝুলন্ত সরু ডাল। প্রজননকালে একই গাছের ভিন্ন ভিন্ন ডালে বাসা বাঁধার প্রবণতা প্রবল।

দুধরাজ-দুধরানির মূল খাদ্য উড়ন্ত কীটপতঙ্গ, লার্ভা ও ফুলের নির্যাস। বসন্ত-বর্ষায় বাসা বানিয়ে চারটি গোলাপি রঙের ডিম পাড়ে দুধরানি। ছানা ফুটতে লাগে ১৫-২১ দিন। ছানাদের জন্য পালাক্রমে খাবার জোগাড় করে আনে দুধরাজ-দুধরানি। তবে খাবার সরবরাহের চেয়ে বাসার নিরাপত্তার দিকেই বেশি নজর থাকে দুধরাজের।

ছবি: মোছাব্বের হোসেন রিবন

দুধরানির সারা জীবনের রঙ লালচে-বাদামি। এদের লেজে ফিতা পালক থাকে না। পুরুষ ছানারা দুই-তিন বছরের মধ্যে লালচে-বাদামি থেকে দুধসাদা রঙের হয়ে ওঠে।

সুদর্শন দুধরাজের ইংরেজি নাম Asian Paradise Flycatcher। বৈজ্ঞানিক নাম terpsiphone paradisi। এরা শাহি বুলবুলি, সাদা সিপাহি বা লাল সিপাহি নামেও পরিচিত।

দুধরাজের সৌন্দর্য মনে করিয়ে দিতে পারে জীবনানন্দের 'পাখি' কবিতার কয়েকটি লাইন- '...তার মুখে স্বপ্ন সাহসের ভর/ব্যথা সে তো জানে নাই- বিচিত্র এ-জীবনের 'পর/করেছে নির্ভর;/ রোম-ঠোঁট-পালকের এই মুগ্ধ আড়ম্বর।'

ছবি: মোছাব্বের হোসেন রিবন

দুধরাজ বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। সারা দেশেই দেখা যায়। একাকী বা জোড়ায় জোড়ায় বিচরণ করে এরা।

নাটোরের লালপুর উপজেলার সালামপুর থেকে সম্প্রতি দুধরাজ-দুধরানির ছবিগুলো তুলেছেন মোছাব্বের হোসেন রিবন

Comments

The Daily Star  | English

Trump slaps allies Japan, South Korea with 25% tariffs

In near-identically worded letters to the Japanese and South Korean leaders, Trump said the tariffs would apply from August 1

1h ago