পাটগ্রামে হারাতে বসেছে নদী

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার কাওয়ামারী এলাকায় ধরলা নদীর তীরে ড্রেজার মেশিন থেকে পাথর ছাঁকছিলেন ৫৫ বছর বয়সী আব্দুস সালাম।
নদীতীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ড্রেজার মেশিন। অনবরত চলছে তাদের গর্জন। লম্বা লোহার পাইপ দিয়ে নদীর তলদেশ থেকে পাথর ও বালু টেনে উঠানো হচ্ছে—তৈরি হচ্ছিল গর্তের পর গর্ত; নদীর ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে ধুলোর মেঘ। নদীতীরে গড়ে উঠেছে পলিমাটির স্তূপ।
'আমি একসময় কৃষক ছিলাম। নদীভাঙনে আমার ছয় বিঘা জমি শেষ হয়ে গেছে। আর কোনো উপায় ছিল না। পরিবার তো চালাতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে এই কাজ করি। আর কী করতে পারি বলেন?' কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে আব্দুস সালামের।
তিনি বলেন, 'পাথর তোলা শুরু করেছিল এলাকার রাজনৈতিক নেতারা। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। কেউ শোনেনি। আর এখন নিজেরাই করি। যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। এটাই আমাদের শেষ আশ্রয়।'
ভারতের দিক থেকে প্রবাহিত তিনটি নদী পাটগ্রাম উপজেলা জুড়ে জালের মতো বিস্তৃত। সেগুলো হলো—৩১.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ধরলা, ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ সিংগিমারি এবং ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ সানিয়াজান।
এক সময় এই নদীগুলো ঘিরে কৃষি, সেচ, মাছ ধরা ও নৌযান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা হতো। এখন বছরের পর বছর ধরে লাগামহীন অবৈধ পাথর উত্তোলনের কারণে নদীগুলো বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।
অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে স্থানীয়রা জানান, এই নদীগুলো তাদের কাছে নৌপথ ছিল না। এগুলো ছিল খাদ্যের উৎস, পরিচয় ও সামাজিক বন্ধনের প্রতীক। অথচ কিছু লোক নদী লুটপাট করে লাভবান হলেও গ্রামগুলোকে টিকে থাকতে হচ্ছে পরিবেশগত বিপর্যয়ের মধ্যে।
বাঁকান্দার ৭৮ বছর বয়সী নাজির আলী বলেন, 'এক সময় এখান দিয়ে নৌকা চলত। এখন শুধু চরের পর চর। বর্ষাকালে কিছুটা পানি দেখা যায়, বাকিটা সময় মরা নদী।'
রসুলগঞ্জের ৭৮ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বলেন, 'ধরলার পাড়ে আমার ১০ বিঘা কৃষিজমি ও পারিবারিক কবরস্থান ছিল। সবই গেছে নদীভাঙনে। এই ভাঙন বেড়েছে লাগামহীন পাথর উত্তোলনের কারণে।'
বাঁকান্দার ৬৫ বছর বয়সী কৃষক শমশের আলী বলেন, 'যারা প্রতিবাদ করেছিল, তাদেরই হয়রানি করেছে প্রশাসন। এখন আর নদীর দিকে তাকানোও যায় না।'
রসুলগঞ্জের ৭০ বছর বয়সী কৃষক মাহতাব আলী বলেন, '৪০০-৫০০ ড্রেজার দিনরাত চলতে থাকে—যেন উৎসব চলে। এই নদীগুলো মরে গেছে। এখন একমাত্র সমাধান হলো সঠিকভাবে খনন করা, লুটপাট না।'
খনির গর্ত, না মৃত্যুকূপ?
কাওয়ামারী গ্রামের ৬০ বছর বয়সী দিনমজুর সুরত আলী জানান, ১৯৯১ সালের দিকে কীভাবে এই পরিস্থিতির শুরু হয়েছিল।
তিনি বলেন, 'আগে আমরা জাল দিয়ে পাথর তুলতাম। পরে রাজনৈতিক প্রভাবশালী লোকেরা ড্রেজার এনে বড় পরিসরে পাথর তুলতে শুরু করল। তখনই শুরু হয় ধ্বংসের।'
বছরের পর বছর ধরে নদীর তলদেশে তৈরি হয়েছে গভীর গর্ত, যা এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত দুই দশকে অন্তত ২০ জন এসব গর্তে ডুবে মারা গেছেন—তাদের মধ্যে ৭ জন শিক্ষার্থী, ৮ জন শিশু ও ৫ জন কৃষক ও শ্রমিক রয়েছেন।
গত বছর ২৫ জুলাই বাঁকান্দা গ্রামের ১২ বছর বয়সী মিসকাত হোসেন একটি খনির গর্তে ডুবে মারা যায়। তার বাবা নুরুল ইসলাম নুরু আজও সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
'ছেলে হারানোর যে কী যন্ত্রণা, কাউকে বোঝাতে পারব না। কত প্রতিবাদ করেছি, কেউ শুনেনি,' বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন নুরু।
পাটগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি ইফতেখার আহমেদ বলেন, 'আমরা এসব মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। কিন্তু প্রশাসন কোনো রেকর্ড রাখেনি, ব্যবস্থাও নেয়নি। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন চলছে আগের মতোই।'
সিন্ডিকেট
দশকের পর দশক ধরে স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও তাদের অনুসারীরা প্রভাব খাটিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন এবং তৈরি করেছেন সিন্ডিকেট।
অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, সিন্ডিকেট সদস্যরা পাথর উত্তোলন থেকে প্রতিদিনের আয়ের প্রায় ১০ শতাংশ স্থানীয় কর্মকর্তাদের দিয়ে থাকেন।
প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৪ হাজার ঘনফুট পাথর ড্রেজার দিয়ে উত্তোলন করা হয়। প্রতি ঘনফুট পাথরের দাম উত্তোলনস্থলে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। ফলে প্রতিদিনের মোট লেনদেন দাঁড়ায় অন্তত ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২৪ হাজার টাকা স্থানীয় কর্মকর্তারা ভাগে পান বলে রাজনৈতিক ও সিন্ডিকেট সূত্র জানিয়েছে।
তবে, চালু থাকা ৪০০-৫০০ ড্রেজারের সবাই এই ভাগ দেয় না। কিছু এলাকায় প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের কাছের লোকজন এই টাকা দেন না।
স্থানীয় এক সিন্ডিকেট সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আগে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত আওয়ামী লীগের নেতারা। এখন বিএনপি নেতাদের হাতে।'
এক সূত্রের দাবি অনুযায়ী, এক সময় সিন্ডিকেটের কার্যক্রম তদারকি করতেন পাটগ্রাম উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র রাশেদুল ইসলাম।
এই অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রাশেদুলকে একাধিকবার কল করা হলেও তার মোবাইল নম্বরটি ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
বিএনপি নেতাদের এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে পাটগ্রাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি শফিকুর রহমান তা অস্বীকার করেন।
তিনি দাবি করেন, 'আমাদের কোনো নেতা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে নেই। আমরা উল্টো আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বারবার প্রশাসনকে অবৈধ পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। কিন্তু প্রশাসন আমাদের কথা আমলে না নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের দোষারোপ করেছে এবং সিন্ডিকেটের কাছ থেকে লাভের অংশ নিচ্ছে।'
প্রশাসন কী বলছে
সরকারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, সংকট গুরুতর।
লালমনিরহাট বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার বলেন, 'অবৈধভাবে লাগাতার পাথর উত্তোলনের কারণে পাটগ্রামের তিনটি নদী মৃত্যুর মুখে।'
তিনি বলেন, 'সম্প্রতি পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের একটি দল নদীগুলো পরিদর্শন করেছে এবং সরেজমিনে বিপর্যয় দেখে গেছে। আশা করি এখন সংস্কারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেন, 'পাথর উত্তোলন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। আমরা প্রতিটি অভিযোগের বিপরীতেই ব্যবস্থা নেই, মোবাইল কোর্ট পাঠাই। ১০০টিরও বেশি ড্রেজার ধ্বংস করেছি, অনেককে জরিমানা করেছি, এমনকি হামলার শিকারও হয়েছি। তারপরও দূর-দূরান্তে রাতের আঁধারে কিছু ড্রেজার চলছে।'
তবে, সিন্ডিকেটের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া বা স্থানীয় প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা অবৈধ বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, 'আমরা সজাগ আছি এবং এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি।'
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক এইচএম রাকিব হায়দার বলেন, 'ধরলা নদীর চার কিলোমিটার এলাকা খননের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। জরিপ শেষ। শিগগির কাজ শুরু হবে।'
তিনি বলেন, 'সিন্ডিকেট যত শক্তিশালীই হোক, আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব।'
আইন ও উদ্বেগ—দুটিই উপেক্ষিত
খনিজ ও খনিজসম্পদ (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৯২ অনুযায়ী বাংলাদেশে লাইসেন্স ছাড়া পাথর উত্তোলন শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
২০১৩ সালের পানি আইন অনুযায়ীও এটা অপরাধ। একই বছরের নদী রক্ষা কমিশন আইন অনুযায়ী, নদীর তলদেশ দখল, দূষণ বা ক্ষতির মতো কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এত এত আইন থাকলেও বাস্তবায়ন হয়েছে খুবই সামান্য। ফলে ধীরে ধীরে নদী, জীবিকা ও জীবন—সবই ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন অবৈধ পাথর উত্তোলনের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করেছে এবং দুইজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
কিন্তু পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। এসব ব্যবস্থা নেওয়ায় পাথর উত্তোলন বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর ফল আসেনি।
বাঁকান্দার ৬৫ বছর বয়সী মোসলেম উদ্দিন বলেন, 'তারা এখনো রাতে পাথর তোলে। অনেক সময় সারাদিন ধরে পাথর উত্তোলন চলে। সেখানে জোরে জোরে গান বাজে, যেন উৎসব। এই লোভী মানুষগুলো নদীটা ধ্বংস করে ফেলেছে।'
লালমনিরহাট নদী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি শফিকুল ইসলামের ভাষ্য, 'যদি দ্রুত এবং ধারাবাহিক ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে পাটগ্রামের নদীগুলো অচিরেই হারিয়ে যাবে।'
Comments