২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগে ৮৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত, তলিয়ে গেছে নিম্নাঞ্চল

রংপুর বিভাগে ৮৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে।

দীর্ঘ সময় দেশের উত্তরাঞ্চলে তাপদাহের পর অসময়ের টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে রংপুরের নিম্নাঞ্চল। পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। এতে করে বিপাকে পড়েছেন দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষরা।

আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগে ৮৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে।

এ বিষয়ে রংপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজার রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগে হওয়া ৮৩১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের মধ্যে নীলফামারীর সৈয়দপুরে সর্বোচ্চ ২৫৯ দশমিক ৪ মিলিমিটার এবং রংপুরে ১০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা এ মৌসুমে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। আরও দুদিন বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টানা বৃষ্টিতে রংপুর নগরীর কামাল কাছনা, মাহিগঞ্জ, বোতলা, নিউ জুম্মাপাড়া, পূর্ব জুম্মাপাড়া, তাজহাট, বাবুপাড়া, কামারপাড়া, আদর্শপাড়া, নগর মীরগঞ্জ, শালবন, মিস্ত্রিপাড়া, কলাবাড়ি দর্শনা, মর্ডান মোড় সংলগ্ন বিভিন্ন মহল্লা, মুন্সিপাড়া, হনুমান তলা, মুলাটোল, মেডিকেল পাকার মাথা ও জলকরসহ বিভাগের আট জেলার বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।

রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়া এলাকার পানের দোকানি সুমন বলেন, পাড়ার মোড়ে ছোট্ট একটি পানের দোকান চালিয়ে সংসার চলে। টানা বৃষ্টিতে দোকান খোলা সম্ভব হয়নি।

বাবুখাঁ এলাকার রিকশাচালক আমিনুল ইসলাম বলেন, একদিন রিকশা নিয়ে বের হতে না পারলে দেনা বেড়ে যায়। শনিবার থেকে টানা বৃষ্টির কারণে বাইরে মানুষের চলাফেরা কমে গেছে। রিকশা বন্ধ করে ঘরে বসে দিন পার করছি।

কুকরুল এলাকার স্বপ্না রানী জানান, রাত থেকে মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে। নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছেন মানুষ।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বলেন, এখন ধানের মৌসুম। এই বৃষ্টি ধানের জন্য খুবই উপকারী। তবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে সবজি ক্ষেতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। যা পানি নেমে যাওয়ার পর বোঝা যাবে।

এদিকে, দিনাজপুরে গত কয়েক দিনের টানা বর্ষনে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে পড়েছে। দিনাজপুরের শহরসহ এর আশেপাশের এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ডুবে গেছে ফসলের খেত।

দিনাজপুরের প্রায় সবকটি নদী বিপদসীমা প্রায় ছুঁইছুই।

দিনাজপুরের আবহাওয়া অফিস গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টির পরিমান ১৫৯ মিলিমিটার।

দিনাজপুর আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, দিনাজপুরে গত বুধবার থেকে বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হলেও গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দিনাজপুরের বৃষ্টির পরিমান ছিল ২০ মিলিমিটার ও ২৩ মিলিমিটার।

গতকাল শনিবার সকাল ৯টা থেকে দিনাজপুরের ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে থেমে থেমে চলে বিকাল পর্যন্ত। তবে সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়ে একটানা আজ রোববার বেলা ১২টায় এই প্রতিবেদন লেখা পযন্ত বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত চলছে।

দিনাজপুর শহরের রাজবাড়ী ও তার আশপাশ এলাকা, বালুয়াডাঙ্গা, বাঙ্গীবেচা ও তার আশপাশ এলাকা, রামনগর ও তার আসপাশ এলাকা বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হয়েছে। অনেক বাড়িতে ঢুকে গেছে পানি।

দিনাজপুর রাজবাড়ী এলাকার রঞ্জিত রায় জানান, গতরাত থেকে ভারী বৃষ্টিপাত শুরু হলে তার ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকে যায়। রাজবাড়ী এলাকার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা থাকলে এমন সমস্যায় তাকে পড়তে হতো না বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে, এই সব নিচু এলাকার পুকুরগুলোও প্লাবিত হওয়ায় মাছ ভেসে গেছে। চাষিরা বলছেন এতে লোকসানের মুখে পড়বেন তারা।

এদিকে, দিনাজপুরের অন্যান্য উপজেলা বিশেষ করে বিরল, খানসামা, চিরিবন্দর, নবাবগঞ্জ, বীরগঞ্জ উপজেলার শহর এলাকাসহ নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

আবহাওয়া বৈরীতায় গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে আমন চাষ নিয়ে সংকটে পড়েছে কৃষকেরা। তবে গত বুধবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া টানা বর্ষনে আমন চাষিদের মুখে হাসির ঝলক দেখা দিলেও, টানা বৃষ্টিতে খেত তলিয়ে যাওয়ায় এখন তারা চিন্তিত।

আগাম সবজি চাষীদের কপালেও চিন্তার ভাজ পড়েছে ।

কমবেশি প্রায় সবকটি উপজেলার ধান খেত বৃষ্টির তলিয়ে গেছে। কৃষকরা জানান বৃষ্টি স্থায়ী হলে ও পানি দ্রুত সরে না গেলে তারা ক্ষতির মুখে পড়বেন।

অন্যদিকে, আর্থিকভাবে মুনাফা লাভ ও স্বাবলম্বী হওয়ার আশায় বীরগঞ্জের অধিকাংশ কৃষক বাড়ির আশেপাশে পতিতসহ  কৃষি জমিতে আগাম শীতকালীন সবজি চাষ করে থাকেন। এবারও তারা ফুলকপি, পাতাকপি, সীম, মুলা, কাঁচামরিচ, টমেটো, বরবটি, বেগুন, পালংশাক, লালশাক, লাউ সবজি চাষ করেছেন। কিন্তু কয়েকদিনের টানা বর্ষনে তলিয়ে গেছে বেশির ভাগ সবজির খেত।

উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার মোট আবাদি জমির পরিমান ৩২ হাজার ৮৯৬ হেক্টর। এর মধ্যে ৯০০ হেক্টর জমিতে আগাম সবজি চাষ করা হয়েছে। এবার খরিপ-২ মৌসুমে সবজি চাষের লক্ষ্য মাত্রা রয়েছে ৯৫২ হেক্টর জমিতে এবং রবি মৌসুমে ২ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কিন্তু কয়েক দিনের তাপদাহের পর গত বুধবার সন্ধ্যা হতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত উপজেলায় ৪৮মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ৮৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম।

এই অতি বৃষ্টির ফলে উপজেলার সবজিগ্রাম খ্যাত সাতোর ইউনিয়নের প্রাণনগরসহ মোহনপুর, শিবরামপুর, সুজালপুর, শতগ্রাম ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার মাঠে থাকা আগাম সবজির ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সবজি চাষিরা। সেই সাথে নেতিয়ে পড়েছে সবজি গাছের চারা এবং উঠতি ফসলের অনেক পানিতে পঁচতে শুরু করেছে এই বৃষ্টিতে।

এ ব্যাপারে উপজেলার সাতোর ইউনিয়নের প্রাণ নগর গ্রামের সবজি চাষি আহমেদ জুয়েল জানান, আমি একটি বেসরকারি এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ৫ একর জমিতে আগাম জাতের ফুলকপি চাষ করেছি। প্রতিটি গাছ বেড়ে উঠেছিল সতেজ হয়ে কিন্তু বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কারণে ফুলকপির গাছগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে এবং নেতিয়ে পড়েছে মাটির সাথে।

একই কথা জানিয়ে সবজি চাষি মো. আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, তিনি ২ একর জমিতে শীতকালীন আগাম সবজি হিসেবে পাতাকপি ও ফুলকপি  চারা রোপন করেছিলেন। আগাম সবজি চাষ করে কয়েক বছর ভালো টাকা আয় হয়েছে। তবে এবার বৈরী আবহাওয়ার অনাবৃষ্টি আর আর প্রচন্ড তাপদাহের পর টানা বর্ষন শুরু হয়েছে। এতে সবজি চারার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

দিনাজপুর শহরে খোলেনি দোকান পাট। শহর একরকম ফাঁকা।

দিনাজপুরের বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় অল্প কয়েকটি বাস চলাচল করছে। ঢাকার বাস সবকটি ছেড়ে গেলেও যাত্রী ছিল কম।

দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক শাকিল আহম্মেদ জানান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। শহরসহ আশেপাশের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি ওইসব এলাকা ঘুরে দেখবেন। ইতোমধ্যে প্যাকেটজাত খাবার ও রান্না করা খাবার বিতরণের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

Comments