খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ
রমজানের আগে একসাথে অনেককিছুর দাম বৃদ্ধি সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। এমনিতেই সময়টি পরিবারগুলোর জন্য বেশি খরচের মাস হিসেবে পরিচিত।
নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়া যেমন বড় একটা ধাক্কা। তেমনি পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলছে মার্চ থেকে কার্যকর হওয়া বিদ্যুতের নতুন দাম। ইউনিটপ্রতি ৩৪ এবং ৭০ পয়সা বাড়ানো হচ্ছে দাম। যা এক বছর আগের তুলনায় ৭ থেকে ১০ শতাংশ বেশি।
এটি এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে লড়াই করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও জানুয়ারিতে ভোক্তা মূল্যসূচক আগের মাসের তুলনায় ৪৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশে পৌঁছেছে।
ডেইলি স্টার গত দুই দিনে রাজধানীর মিরপুর, পূর্ব শেওড়াপাড়া, কচুক্ষেত, মহাখালী, গুলশান, কড়াইল ও কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর ১১টি কাঁচাবাজার ঘুরে দেখেছে।
কয়েকবারের দাম বৃদ্ধির পর দেখে মনে হয় বাজার দর স্থিতিশীলই আছে। তবে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের জন্য, দাম ইতোমধ্যে নাগালের বাইরে চলে গেছে এবং নতুন বিদ্যুতের দাম কার্যকর হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
একটি কারখানার শ্রমিক হাজেরা বেগম ও তার স্বামী আলপন মিয়া জানান, তারা দুই জন মিলে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করেন। কিন্তু এই আয় গ্রামে তাদের দুই সন্তানের স্কুলের খরচ, পরিবারের বৃদ্ধ বাবা-মায়ের ভরণপোষণের জন্য যথেষ্ট নয়।
কড়াইল বস্তিতে সাড়ে তিন হাজার টাকা বাসাভাড়া, খাওয়া, বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল, যাতায়াতের খরচের পর তাদের গ্রামে পাঠানোর মতো খুব সামান্য টাকাই থাকে। পাঁচ বছর আগেও কম আয় করলেও সঞ্চয় করতে পারতেন। কিন্তু গত কয়েক বছরে তাদের আয় না বাড়লেও জানুয়ারি থেকে ভাড়া বেড়েছে ৭০০ টাকা। সামনের মাস থেকে বিদ্যুতের দাম বাড়ায় ভাড়া আবারও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
আলপন মিয়া বলেন, 'মুদি দোকান থেকে জিনিস কেনার জন্য আগে ২০০ টাকাই যথেষ্ট ছিল। এখন ৩০০ টকাও কম।'
হাজেরা বেগম জানান, তাদের খাবারে তালিকায় থাকে সপ্তাহে দুই বার সস্তার মাছ এবং বেশিরভাগ দিন ভাতের সঙ্গে শুটকি, ডাল আর ডিম।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মানুষের কাছে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পূর্ব শেওড়াপাড়ায় সরকারের খোলা বাজার বিক্রয় কর্মসূচির একটি ভ্রাম্যমাণ দোকানের কর্মী মোহাম্মদ হাসান বলেন, 'যেহেতু আমাদের ট্রাক থেকে যে কেউ পণ্য কিনতে পারেন, তাই দরিদ্রদের পাশাপাশি এখন অনেক বাড়ির মালিক এবং মধ্যবিত্তরাও আজকাল আমাদের দোকানের পেছনে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন।
কারওয়ান বাজার ও কচুক্ষেতে সাধারণ জাতের খেজুর যা ইফতারের একটি নিয়মিত খাবার, বিক্রি হচ্ছে ৫০০-১১০০ টাকা কেজিতে, যা গত রমজানেও ছিল ২৫০-৪৫০ টাকা। চলতি মাসের শুরুতে সরকার চাল, চিনি ও খেজুরের আমদানি শুল্ক কমানোর পরও এই দাম দেখা গেছে।
সম্প্রতি সয়াবিন তেলের দাম কমেছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল যা আগে ৮৩৫-৮৪০ টাকা ছিল, এখন তা ৮১০-৮২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, শুল্ক কমানোর পরও চিনি এখন কেজিতে ১৪০-১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহের চেয়ে ৫-১০ টাকা বেশি।
রমজানের অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মধ্যে ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০৫ টাকা কেজি, যা দুই সপ্তাহ আগের তুলনায় ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। আর মুড়ি ৫-১০ টাকা বেড়ে ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, রমজানকে সামনে রেখে বিক্রেতারা মুড়ি মজুদ করতে শুরু করেছেন।
এক মাসের বেশি সময় ধরে দেশি মশুর ডালের দাম কেজিপ্রতি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
গরু ও খাসির মাংস বেশ অনেকদিন ধরেই নিম্ন আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। গরুর মাংসের দাম দুই মাস আগের কেজিতে ৬৫০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৭৫০ টাকায় এবং খাসির মাংস এখন ১১০০ থেকে ১১৫০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বেড়েছে মুরগির দামও। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২০০ টাকা, সোনালী মুরগি ২৯০ থেকে ৩৩০ টাকা এবং দেশি মুরগি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ডিম এখন প্রতি ডজন ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েকদিন আগের দামের চেয়ে প্রায় ৫ টাকা কম।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় জিরার দাম বেড়েছে ৩২ শতাংশ।
কারওয়ান বাজারের মেসার্স আল আমিন ট্রেডার্সের মালিক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ইসবগুলের দাম এখন দুই হাজার টাকা, যা আগে ছিল ৯০০ টাকা, রুহ আফজা ৫৫০ টাকা, যা গত রমজানে ৩৮০ টাকা ছিল।
রমজানে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দামের ঊর্ধ্বগতির ভোক্তাকে এক দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলছে।
বিদ্যুতের আসন্ন দাম বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পেট্রোবাংলার সাবেক কর্মকর্তা মাহবুবা বেগম বলেন, বিদ্যুত বিল বাড়লে প্রায় সব কিছুরই দাম বেড়ে যায়।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, 'বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের দিকে ইঙ্গিত করবে সরকার। আমরা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছি এবং কুইক রেন্টাল পাওয়ার নিয়েছি। এগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থতার প্রমাণ দেয়। আমি সরকারকে অনুরোধ করছি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে, অপচয় বন্ধ করতে এবং এই খাতে স্বচ্ছতার অভাব দূর করতে।
'আমাদের আশঙ্কা, রমজানে মানুষ কষ্ট পাবে।'
Comments