কানাডা-ভারত কূটনীতিক সম্পর্কে টানাপোড়েনের পরিণতি কী

এমন প্রেক্ষাপটে কানাডা-ভারতের মধ্যে চলমান এই বৈরি অবস্থা শান্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে, তাই দেখার অপেক্ষা।
জাস্টিন ট্রুডো ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত

ইউরোপে ৬০ লাখ ইহুদিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। রক্তাক্ত এই ইতিহাস 'ইউরোপ হলোকাস্ট' নামে পরিচিত। যার নেতৃত্ব দেন অ্যাডলফ হিটলারের জেনারেলদের অন্যতম একজন অ্যাডলফ আইখম্যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অন্যদের মতো তিনি আত্মঘাতী হননি। পালিয়ে যান আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে। সেখানে খনি শ্রমিকের কাজ নেন। পরিবার নিয়ে একেবারে সাদামাটা জীবন যাপন করতেন ইহুদিদের হত্যার মাস্টারমাইন্ড আইখম্যান।

১৯৬০ সালে ইসরায়েলি গোয়ন্দা সংস্থা মোসাদের কাছে জার্মানি থেকে একটি বার্তা আসে। তাতে বলা হয়, অ্যাডলফ আইখম্যান আর্জেন্টিনায় ছদ্মবেশে পালিয়ে আছেন। তখন সদ্য গঠিত রাষ্ট্র ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়ায় ব্যস্ত। তৎকালীন মোসাদ প্রধান ইজার হাজেল এতসব ঝামেলার মধ্যে প্রথমে খবরটিকে গুজব ভেবেছিলেন। তবে মোসাদ এজেন্ট পিটার মালকিনের কথায় ইজার হাজেল ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেন।

অ্যাডলফ আইখম্যানকে আর্জেন্টিনায় মেরে ফেলা ছিল মোসাদের জন্য তুলনামূলক সহজ কাজ। তবে ইজার হাজেল চেয়েছিলেন তাকে ইসরাইলে ফিরিয়ে এনে বিচারের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে। আইখম্যানকে ফিরিয়ে আনতে মোসাদ গঠন করে বিশেষ টিম। আর্জেন্টিনা কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে অ্যাডলফ আইখম্যানকে জেরুজালেমে ফিরিয়ে আনে মোসাদের টিম। দ্রুততম সময়ে আইখম্যানের বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করা হয়। অবিশ্বাস্য এই অভিযানকে পৃথিবীর অন্যতম সফল গোয়েন্দা অভিযান হিসেবে অবিহিত করা হয়। এই অভিযানের নাম ছিল 'অপারেশন ফিনালে'। মোসাদের এই সত্য ঘটনা অবলম্বনে হলিউডে নির্মাণ করা হয় 'অপারেশন ফিনালে' সিনেমা।

পৃথিবীর নানা প্রান্তে এভাবে রুদ্ধশ্বাস গোয়েন্দা অ্যাডভেঞ্চার বিরল নয়। গোয়েন্দা সংস্থার হাতে গুপ্ত হত্যারও নজির কম নয়। তবে এসব ক্ষেত্রে খুবই পরিকল্পিতভাবে ঘটনাগুলো ঘটে। অনেক সময় এসব ঘটনায় কারা জড়িত সেটি অনুমান করা গেলেও পর্যাপ্ত তথ্যউপাত্ত না থাকায় প্রমাণ হাজির করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিচারপ্রক্রিয়া তো আরও পরের বিষয়। তবে বিদেশের মাটিতে অননুমোদিত গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাতে গিয়ে আটক হওয়ার নজিরও রয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সন্দেহভাজন মোসাদের কয়েকজন এজেন্টকে আটকের অভিযোগ করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।

গত ১৮ জুন কানাডার ভ্যানকুভারে নির্বাসিত শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সম্প্রতি এ হত্যার সঙ্গে ভারত সরকারের জড়িত থাকার অভিযোগ করেছে কানাডা। এ ঘটনার জেরে অটোয়ায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা 'র' প্রধানকে বহিষ্কার করে কানাডা। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতও নয়াদিল্লিতে কানাডার এক শীর্ষ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পার্লামেন্টে বলেন, হরদীপ খুনের সঙ্গে ভারতীয় এজেন্টদের যুক্ত থাকার বিষয়ে তার সরকারের কাছে 'বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ' আছে। ট্রুডো আরও বলেন, 'কানাডার মাটিতে কানাডীয় নাগরিককে হত্যার সঙ্গে বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি আমাদের সার্বভৌমত্বের অগ্রহণযোগ্য লঙ্ঘন।'

অটোয়া ও নয়াদিল্লির পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক বহিষ্কারের ঘোষণার পর ভারত তার দেশের নাগরিকদের কানাডা ভ্রমণের বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। কানাডায় 'ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী তৎপরতা' ও 'ঘৃণ্য অপরাধ ও সহিংস পরিস্থিতির' কথা বলে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের সতর্কভাবে চলাচলের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কানাডার নাগরিকদের জন্য ভারতের ভিসা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে কানাডাও ভারতে তাদের বাণিজ্য মিশন স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। তার মানে জল বেশ অনেক দূরে গড়িয়েছে।

টরন্টো স্টার জানিয়েছে, কানাডার সাবেক কূটনীতিক প্যাট্রিসিয়া ফর্টিয়ার ভারত-কানাডার মধ্যে চলমান ঘটনাকে 'হতভম্বকর' উল্লেখ করে বলেন, কোনো দেশ থেকে আরেক দেশের কূটনীতিককে সরিয়ে দেওয়া কোনো হালকা বিষয় নয়। দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা নিয়ে কোনো সমাধানে আসতে না পারলে কেবল এমন কাজ করে থাকে।

তিনি আরও বলেন, কূটনীতিক জগতে এটি খুবই কঠিন পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে এক দেশ আরেক দেশকে তার তীব্র অসন্তোষের বার্তা দিতে চায়।

পাঞ্জাবসহ ভারতের বেশ কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে 'আন্দোলন' করে আসছেন শিখরা। তবে ভারত সরকার তাদের 'সন্ত্রাসী' হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। বিশেষ করে নিহত হরদীপ সিং ভারত সরকারের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকায় ছিলেন। ভারতে শিখদের ওপর সরকারি দমন-পীড়নের অভিযোগের বিষয়টি পুরোনো। মাঝে তা কমে আসে। এরই মধ্যে শিখদের একটি অংশ কানাডায় স্থায়ী হয়েছেন। সেখানে থেকেই স্বাধীন 'খালিস্তান' আন্দোলনে সক্রিয় তারা। কানাডার স্থানীয় রাজনীতিতেও শিখদের প্রভাব লক্ষণীয়। মোট ভোটারের দুই শতাংশ শিখ। এ কারণে ট্রুডো সরকারসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে বিষয়টি মাথায় রাখতে হচ্ছে।

হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছেন কানাডাপ্রবাসী শিখরা। ক্ষোভ এত তীব্র হয়ে উঠেছে যে, ভারতবিরোধী দুর্গ গড়তে কানাডার সব রাজনৈতিক দলকে 'ঐক্যফ্রন্ট গঠন'র আহ্বান জানাচ্ছে শিখদের দুটি সংগঠন 'অন্টারিও গুরুদ্বার কমিটি' ও 'ব্রিটিশ কলম্বিয়া গুরুদ্বার কমিটি'।

হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ড তদন্তে যুক্তরাষ্ট্রসহ ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্সের সহায়তা নেওয়ার কথা প্রকাশ্যেই জানিয়েছে কানাডা। ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্স হলো গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের একটি প্ল্যাটফর্ম। কানাডা ছাড়াও  যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য এর সদস্য। তারা সবাই কানাডার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত।

অথচ এখন জানা যাচ্ছে, ভারতও খালিস্তানপন্থি নয়টি নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠনের তালিকা কানাডাসহ ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্সের দেশগুলোর সঙ্গে বিনিময় করেছে।

এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেশ চিন্তা-ভাবনা করে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে অন্য দেশগুলো। বিশেষ করে ফাইভ আইজ ইন্টেলিজেন্সসহ পশ্চিমা দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া এখানে বিশেষ অর্থবহ।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো যে অভিযোগগুলো তুলেছেন, সেগুলো নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এ তদন্তে কানাডার সঙ্গে ভারতের কাজ করা জরুরি। আমরা জবাবদিহি দেখতে চাই।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলি বলেছেন, কানাডা যা বলছে, তা তার দেশ খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে।

প্রায় কাছাকাছি ভাষা ব্যবহার করে অস্ট্রেলিয়াও জানিয়েছে, এই ঘটনায় তারাও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

যদিও ভারত শুরু থেকেই জাস্টিন ট্রুডোর অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। বরং ভারতের অভিযোগ, এটি কানাডায় 'খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের' আশ্রয় দেওয়ার ইস্যু থেকে মনোযোগ ঘোরানোর জন্য করা হচ্ছে।

এই ঘটনা চীনকে ঠেকাতে রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্ক ও নতুন পাওয়ার হাউস হওয়ার সহযোগী পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের রসায়নে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

ভুলে গেলে চলবে না ভারত এই মুহূর্তে বিশ্বের পঞ্চম অর্থনীতি। আবার এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় পশ্চিমা বিশ্বের উদীয়মান ঘনিষ্ঠ সহযোগী, যারা একইসঙ্গে দ্বি-মেরু বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে। 
চীন-রাশিয়া বলয়ের ব্রিকসে যেমন ভারতের সরব উপস্থিতি, একইভাবে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত কোয়াডেরও ভারত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আবার কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। এমন প্রেক্ষাপটে কানাডা-ভারতের মধ্যে চলমান এই বৈরি অবস্থা শান্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র কী করবে, তাই দেখার অপেক্ষা।

Comments