ইরানের পরমাণু কর্মসূচি আশীর্বাদ না অভিশাপ?

ইরানে পরমাণু কর্মসূচির শুরু হয় ১৯৫০ এর দশকে
তেহরান পরমাণু কেন্দ্র সেন্ট্রিফিউজ পরিদর্শন করছেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

'দ্য ওয়ার্ল্ড উইল রিমেম্বার দিস ডে'— পরমাণু বোমার জনক হিসেবে পরিচিত ড. জে রবার্ট ওপেনহেইমারের এমন সগোক্তি বিশ্ববাসী স্মরণ করছে ভিন্নভাবে।

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় পরমাণু বোমা ফেলার মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতার ইতিহাসে যে জঘন্যতম ঘটনা সংগঠিত হয় তার স্মরণে সারাবিশ্বে পালিত হয় 'হিরোশিমা দিবস'।

এ বছর সেরা ছবিসহ সাত বিভাগে অস্কার জেতা পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলানের 'ওপেনহেইমার'র কল্যাণে বিশ্ববাসী আরও ভালোভাবে জেনেছেন বিশ্বরাজনীতিতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে পরমাণু বোমার গুরুত্ব কতখানি। জেনেছেন—এই গণবিধ্বংসী অস্ত্র অর্জন করতে কতটা কাঠখড় পোহাতে হয়।

পরমাণু বোমার এমন জনবিধ্বংসী ভূমিকার প্রেক্ষাপটে গত ২১ এপ্রিল ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্ট'র এক সংবাদ শিরোনামে বলা হয়—'ইরান, এরপর আঘাত আসতে পারে পরমাণু কেন্দ্রগুলোয়'।

বলাই বাহুল্য, সামরিক দিক বিবেচনায় একটি দেশের মর্যাদা বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে 'পরমাণু বোমা'র ভূমিকা অপরিসীম। তাই অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির দেশ উত্তর কোরিয়াকে সমীহ করতে হয় অপেক্ষাকৃত সবল অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়াকেও।

আবার শুধু পরমাণু বোমার কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ভারতকেও সমঝে চলতে হয় ভঙ্গুর অর্থনীতির পাকিস্তানকে।

ঠিক একই ভাবনায় মধ্যপ্রাচ্যে 'একমাত্র পরমাণু শক্তিধর' দেশ হিসেবে ইসরায়েলকে দেখা হয় ভিন্ন দৃষ্টিতে। তাই এ প্রশ্ন উঠতেই পারে যে—তেল আবিবকে টেক্কা দিতে তেহরানও কি সেই পথেই হাঁটছে?

আবার ইরানের দীর্ঘদিনের পরমাণু কর্মসূচি দেশটির জন্য আশীর্বাদ না কি অভিশাপ—এমন প্রশ্ন জাগাও অস্বাভাবিক নয়।

বিপ্লবের আগে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ইরানে পরমাণু কর্মসূচির শুরু সেই ১৯৫০ এর দশকে। উপসাগরীয় দেশটির পরমাণু কর্মসূচির ধারাবাহিকতা নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস'র প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীতে আরও কোনো দেশ যেন সভ্যতা বিনাশকারী পরমাণু বোমা তৈরি না করে তাই হিরোশিমা ও নাগাসাকি ধ্বংসের পর যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দেয় 'শান্তির জন্য পরমাণু' কর্মসূচির।

১৯৫৭ সালের ৫ মার্চ এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ওয়াশিংটন ও তেহরান বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতা চুক্তি সই করে। চুক্তি অনুসারে ইরানকে কারিগরি সহায়তা ও পরিশোধিত ইউরেনিয়াম সরবরাহ করে যুক্তরাষ্ট্র।

এরপর ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানের শাসক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভী তেহরান পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলেন।

১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র তেহরান পরমাণুকেন্দ্রে প্রথম গবেষণা রিঅ্যাকটর পাঠায়। পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম সেই রিঅ্যাকটরটি এখনো কার্যকর।

ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস'র তথ্য বলছে, ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই ইরান পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে (এনপিটি) সই করে। ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির পার্লামেন্ট চুক্তিটির অনুমোদন দেয়। এর অধীনে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৈধতা পায়।

১৯৭৪ সালের ১৫ মে ইরান জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পরমাণুশক্তি এজেন্সির (আইএইএ) সঙ্গে পরমাণু নিরাপত্তা চুক্তি করে। সেই চুক্তির মাধ্যমে আইএইএ ইরানের কেন্দ্রগুলোর শান্তিপূর্ণ কাজে পরমাণু গবেষণা করছে কি না তা পরিদর্শনের অনুমতি পায়।

সেই বছরের নভেম্বরে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি ইরানের বুশেহরে ১২শ মেগাওয়াটের লাইট ওয়াটার রিঅ্যাকটর নির্মাণে রাজি হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টে।

ইরানের বুশেহর পরমাণু কেন্দ্র। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

ইরানের জ্বালানিশিল্পে বৈচিত্র্য আনতে পূর্ণ উদ্যমে পরমাণু কর্মসূচি চালানোর বিষয়ে রেজা শাহর পরিকল্পনাকে সমর্থন জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড। শাহ চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা পরমাণু জ্বালানি প্রক্রিয়াজাত করে ২৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে।

শাহের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন জানিয়ে ১৯৭৬ সালের ২০ এপ্রিল ন্যাশনাল সিকিউরিটি ডিসিশন মেমোরেন্ডাম জারি করেন প্রেসিডেন্ট ফোর্ড। তিনি ইরানের ২৩ পরমাণু রিঅ্যাকটর তৈরির পরিকল্পনায় সহায়তার ঘোষণাও দেন। কিন্তু, বাধ সাধে তার প্রশাসন।

ফোর্ড প্রশাসন চায়নি শাহের অধীনে ইরান পরমাণু গবেষণা নিয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করুক।

এমন পরিস্থিতিতে শুরু হয় ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব।

১৯৭৭ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার সেই দ্বন্দ্ব দূর করার চেষ্টা করেন। পরের বছর জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু'র মর্যাদা দিলেও ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর পুরোপুরি পাল্টে যায় দৃশ্যপট। তেহরানের গবেষণা কেন্দ্রে জ্বালানি পাঠানো বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ইরান খরচ বহনে ব্যর্থ হওয়ায় পশ্চিম জার্মানিও সরে আসে বুশেহর থেকে।

বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে পরমাণু কর্মসূচি

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিল'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসলামি বিপ্লবের পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে এত বেশি আলোচনা হচ্ছে যে অবস্থা দেখে মনে হয়, ইসলামি প্রজাতন্ত্রটিই চায় পরমাণু বোমা তৈরি করতে।

অথচ, মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে যে ১৯৭৪ সালের জুনে শাহ রেজা পাহলভী বলেছিলেন, 'এই অঞ্চলে কেউ পরমাণু বোমা তৈরি করলে ইরানও তা করবে।' এমনকি, কত দ্রুত তা করা হবে যে বিষয়ে কারো কোনো ধারণাই নেই বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

ব্যক্তিগতভাবে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে বেশি আগ্রহী শাহ পাহলভী মনে করতেন, এই কর্মসূচির প্রাথমিক উদ্দেশ্য জ্বালানি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনা। তবে 'আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তন' আনার পথও খোলা ছিল।

ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যায়। বিপ্লবের নেতারা মনে করতেন, এটি খুবই ব্যয়বহুল। শুধু তাই নয়, পরমাণু প্রযুক্তি ইরানকে পশ্চিমের ওপর নির্ভর করে রাখবে। এগুলো বিপ্লবের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

১৯৮০ সালে শুরু হওয়া প্রতিবেশী ইরাকের সঙ্গে আট বছরব্যাপী যুদ্ধ আবারও সব হিসাব পাল্টে দেয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর ভাষ্য—ইরানি সেনাদের ওপর ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন রাসায়নিক বোমা হামলা চালালে তেহরান পরমাণু কর্মসূচি আবার চালু করে।

সংস্থাটি জানায়, ১৯৮২ সালে ইরান পরমাণুবিষয়ক বেশকিছু সম্মেলন আয়োজনের পাশাপাশি ছোট পরিসরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করে। এরপর, ইরান প্রতিবেশী পাকিস্তানের 'পরমাণু বোমার জনক' আবদুল কাদির খানের সহায়তায় পরমাণু বোমা তৈরির উপাদান সেন্ট্রিফিউজ কিনতে শুরু করে।

ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস'র তথ্য অনুসারে—১৯৯০ সালের ৯ অক্টোবর ইরান বুশেহর পরমাণু প্রকল্প আবারও চালুর ঘোষণা দেয়।

১৯৯২ সালের ২৫ আগস্ট ইরান পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে সহায়তার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সদ্য তৈরি হওয়া রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি করে। সেই চুক্তিতে একটি নতুন পরমাণু প্ল্যান্ট তৈরির বিষয়ও ছিল।

১৯৯৫ সালে রাশিয়ার পরামণুশক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আরেকটি চুক্তি করে ইরান। সেখানে আইএইএর নজরদারিতে বুশেহরে একটি লাইট ওয়াটার রিঅ্যাকটর তৈরির কথা বলা হয়।

২০১০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ঘোষণা দেন যে তার দেশ ২০ শতাংশ পরিশোধিত ইউরেনিয়াম উৎপাদন করেছে। তেহরান আরও বেশি মাত্রায় ইউরেনিয়াম পরিশোধন করতে সক্ষম বলেও জানান তিনি।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ধোঁয়াশা

ইরানের পরমাণু গবেষণায় অগ্রগতি নিয়ে পশ্চিমের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সবসময় 'অতিরঞ্জিত' তথ্য দিয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে আটলান্টিক কাউন্সিল'র এক প্রতিবেদনে।

১৯৮৪ সালে সিআইএ পূর্বাভাস দিয়ে বলেছিল, ইরান পরমাণু বোমা বানানোর দ্বারপ্রান্তে। তবে সেসময় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিল জানায়, পরমাণু বোমা বানাতে ইরানের আরও কয়েক বছর এমনকি এক দশকও লেগে যেতে পারে।

বাস্তবতা হচ্ছে, ২০২৪ সালে এসেও ইরান পরমাণু বোমা তৈরি করতে পারেনি।

গত বছরের ১ অক্টোবর জেরুজালেম পোস্ট জানায়, ইরান দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে পরমাণু বোমা বানানোর উপযোগী উপাদান উৎপাদন করতে সক্ষম।

আবার একই প্রতিবেদনে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বলা হয়, 'যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইরান এই সময়ে পরমাণু বোমা বানানোর পথে হাঁটছে না।'

ইরানের পরমাণু বোমাকে ইসরায়েল বিশ্ববাসীর জন্য হুমকি মনে করলেও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে এ ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া বড় হুমকি।

সম্প্রতি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক মতামতধর্মী নিবন্ধের শিরোনাম করা হয়, 'ইরানকে পরমাণু গবেষণায় উৎসাহ দিচ্ছে চীন ও রাশিয়া'। পরমাণু গবেষণায় গতি আনতে তেহরান দুই মিত্র মস্কো ও বেইজিংয়ের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে বলে এতে জানানো হয়।

গত ৮ এপ্রিল সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বল্টন যুক্তরাজ্যের 'টাইমস রেডিও'কে জানান যে, তিনি মনে করেন—উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় ইরান ৭২ ঘণ্টার মধ্যে পরমাণু হুমকিতে পরিণত হতে পারে।

অথচ ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সিএনএন জানায়, তেহরান যে বর্তমানে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে কাজ করছে এ বিষয়ে 'সুনিশ্চিত সাক্ষ্যপ্রমাণ' নেই বললেই চলে।

গত ১৯ এপ্রিল সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, আইএইএ বলেছে—কয়েকটি বোমা বানানোর মতো উপকরণ ইরানের হাতে আছে…। সংস্থাটির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের শেষে ইরান পরমাণুর ৬০ শতাংশ পরিশোধনের গতি কিছুটা ধীর করেছে।

এ কথা সবাই জানেন, ২০২১ সালেই ইরান পরমাণুর ৬০ শতাংশ পরিশোধনের ঘোষণা দিয়েছিল।

আইএইএর মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রোসির অভিযোগ, পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের যতটা সহযোগিতা করা প্রয়োজন তা করছে না।

গত ২২ এপ্রিল জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে'কে বলেন, একটি দেশ বোমা বানানোর সমপরিমাণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করলেই যে সেই দেশ বোমা বানিয়ে ফেলল বিষয়টি এত সহজ নয়। বোমা বানানোর জন্য আরও অনেক উপকরণের প্রয়োজন।

ইরানের পরমাণু কর্মসূচি প্রসঙ্গে তার মন্তব্য, 'তেহরান শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য ইউরেনিয়াম পরিশোধিত করছে। কিন্তু, এর জন্য কত পরিমাণ পরিশোধন প্রয়োজন সেটাই প্রশ্ন।'

তার মতে, 'ইরান যে পরিমাণে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে তা বোমা বানানোর জন্য উপযোগী। তাই বলে ইরান যে বোমা বানাতে যাচ্ছে তা বলা যাবে না।'

ইরানের পরমাণু চুক্তি ও বিশ্বশক্তির অবস্থান

জাতিসংঘের পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ'র ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ২০০৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আইএইএ'র তৎকালীন মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলবারাদি ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ খাতামির ও দেশটির পরমাণু কর্মসূচির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে তেহরানে যান।

সেখান থেকে ফিরে এসে পরের মাসে তিনি সংস্থাটির গভর্নর বৈঠকে বিষয়টি তুলে ধরেন।

এরপর ধীরে ধীরে ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে যুক্ত হয়ে পড়ে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো।

দীর্ঘ আলোচনার পর অবশেষে ২০১৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, পাঁচ বিশ্বশক্তি ও জার্মানির সঙ্গে ইরানের পরমাণু নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি হয়।

বিশ্বশক্তির সঙ্গে পরমাণু চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পর তেহরানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুসাইন আমির-আব্দোল্লাহিয়ান। রয়টার্স ফাইল ফটো

চুক্তি অনুসারে ইরান পরমাণু সমৃদ্ধকরণ, গবেষণা ও উন্নয়ন আগামী ১৫ বছরের জন্য সীমিত করবে। এ ছাড়াও, আগামী ২৫ বছর ইরানের পরমাণু কর্মসূচি আইএইএর নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকবে।

বিনিময়ে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা পাঁচ বছর ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের নিষেধাজ্ঞা আট বছরের জন্য শিথিল করা হবে।

পরে ২০১৮ সালের ৮ মে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে সরিয়ে নিলে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আবারও বৈশ্বিক সংকট শুরু হয়।

এখন সংকট এতটাই বেড়েছে যে, আশঙ্কা হচ্ছে—যেকোনো সময় ইরানের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রগুলোয় হামলা হতে পারে। এ জন্য সন্দেহের আঙ্গুল মূলত ইসরায়েলের দিকে।

ইরানের পরমাণু প্ল্যান্টে ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে আইএইএর মহাপরিচালকের বক্তব্য, 'এমনটি হলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের ভয়ঙ্কর লঙ্ঘন। কোনো দেশই কোনো দেশের পরমাণু প্ল্যান্টে হামলা চালাতে পারে না।'এমনটি যেন না নয় সে জন্যই বিশ্ববাসী গত প্রায় ৭০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে বলেও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন।

আশীর্বাদ না অভিশাপ?

বিজ্ঞান 'আশীর্বাদ না অভিশাপ' তা নিয়ে বিতর্ক বিশ্বব্যাপী। এ কথা অস্বীকার করা উপায় নেই—পরমাণু শক্তির সুফল মানবজাতিকে একদিকে যেমন সভ্যতার শিখরে তুলে আনতে পারে অন্যদিকে এর অপব্যবহার মুহূর্তেই পৃথিবীকে বানিয়ে দিতে পারে মৃত গ্রহে।

তাই হয়ত ড. ওপেনহেইমার আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বিশ্ববাসী একদিন তাকে 'দ্য ডেস্ট্রয়ার অব ওয়ার্ল্ডস' বলে ঘৃণা করবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪২ সালে যখন 'ম্যানহাটন প্রজেক্ট'র মাধ্যমে লস আলামোস ল্যাবরেটরিতে পরমাণু বোমা বানানোর প্রক্রিয়া চলছে তখন পরমাণু বোমার ধ্বংসের ব্যাপ্তি বোঝাতে গিয়ে ওই প্রকল্প থেকে বেরিয়ে আসা এক সহকর্মী ড. ওপেনহেইমারকে বলেছিলেন, 'দিস ইজ নট অ্যা নিউ ওয়েপন। ইট ইস অ্যা নিউ ওয়ার্ল্ড'।

পরমাণু বোমার ধ্বংসলীলা দেখে মানুষ এক নতুন পৃথিবী গড়ার দিকে মনোযোগ দেবে এমনটি আশা করা হলেও ঘটেছে বিপরীত ঘটনা। নিজেদের জাতিগত আভিজাত্য তুলে ধরতে শক্তিশালী ও সক্ষম দেশগুলো পরমাণু বোমার অধিকারী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে।

আবার, দেশে দেশে শুরু হয় 'শান্তিপূর্ণ কাজে' পরমাণু গবেষণাও।

গত ৮ এপ্রিল ইরানি সংবাদমাধ্যম তেহরান টাইমস জানায়—ইরানের জাতীয় পরমাণু প্রযুক্তি দিবস উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে দেশটির পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি বলেন, 'বাহ্যিক চাপে আমরা গর্তে ঢুকে যাব না।'

পরমাণু গবেষণায় দেশটির অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি জানান, ২০২৩ সালে ইরান মেডিক্যাল ও রেডিওফার্মাসিউটিক্যাল খাতে ১৫টি নতুন সাফল্য পেয়েছে। তার দাবি, দেশটি রেডিওফার্মাসিউটিক্যাল খাতে আলফা রশ্মি ব্যবহার নিয়ে আলোচনাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। সারাবিশ্বে ইরান এই প্রথম এমন মাইলফলক সৃষ্টি করেছে।

তিনি বলেন, 'ক্যানসার রোগীদের সফল চিকিৎসায় আমাদের অর্জিত জ্ঞান ও উদ্ভাবন নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে আছে। আমরা সেই ধারা বজায় রেখে চলছি।'

ক্যানসারাস টিউমার ও নিউরোলগিক্যাল টিউমার দূর করতে ইরানের রেডিওফার্মাসিউটিক্যালের কার্যকারিতাও তুলে ধরেন তিনি।

অপর এক অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ এসলামি ইরানের পরমাণু প্ল্যান্টের সম্প্রসারণের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে বলেন, 'বুশেহর, খুজেস্তান ও মাকরানে নতুন প্ল্যান্ট তৈরি করা হবে।'

ইরানের জাতীয় পরমাণু শক্তি দিবসে তেহরানে সেন্ট্রিফিউজ দেখানো হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স ফাইল ফটো

গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইসলামি বিপ্লবের ৪৫তম বার্ষিকী উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান দাবি করেন, পরমাণু গবেষণায় কয়েকটি বিভাগে ইরানের অবস্থান বিশ্বে শীর্ষ পাঁচের মধ্যে আছে।

এত সাফল্যের পরও পরমাণু গবেষণার জন্য বেশ মূল্য দিতে হচ্ছে ইরানকে।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৭ সালের পর থেকে ইরানের অন্তত ছয় শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য তেহরান বরাবর তেল আবিব ও ওয়াশিংটনকে দায়ী করে আসলেও তারা তা স্বীকার বা অস্বীকার করেনি।

সর্বশেষ, ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর ইরানের প্রধান পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে রাজধানী তেহরানে দূর নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র ব্যবহার করে হত্যা করা হয়।

এ সংক্রান্ত বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিমের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে যে ফাখরিজাদেহ ইরানের গোপন পরমাণু বোমা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

শুধু পরমাণু বিজ্ঞানীই নয়, দেশটির পরমাণু কেন্দ্রগুলোতেও নানান সময় 'নাশকতামূলক' হামলা হয়েছে।

ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের পর থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলোকে লক্ষ্য করে অন্তত দুই ডজন হামলা হয়েছে। আছে সাইবার অ্যাটাকও।

গত বছরের ২৮ জানুয়ারিও মধ্যরাতে মধ্য ইস্পাহানে আত্মঘাতী ড্রোন হামলার শব্দ শোনা যায়।

তাই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশ্ন জাগে—খনিজ জ্বালানি সমৃদ্ধ ইরানের সাফল্যের 'মেরুদণ্ড' হিসেবে পরিচিত যে পরমাণু গবেষণার জন্য দেশটিকে প্রায় অর্ধ শতক ধরে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে তা দেশটির জন্য আশীর্বাদ না অভিশাপ?

Comments