গাজা থেকে যেভাবে হজে গেলেন ফিলিস্তিনি প্রকৌশলী

অন্য অনেক মুসলিম প্রধান অঞ্চলের মতো গাজা থেকেও মক্কায় হজ করতে এসেছেন ফিলিস্তিনিরা। তবে অন্যদের মতো তাদের আসার প্রক্রিয়াটি অতটা সহজ ছিল না।
গতকাল রোববার এএফপির প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনি হজযাত্রীদের ভাবনার কথা জানানো হয়েছে।
গাজা থেকে আসা হজযাত্রীদের মনে প্রশান্তির ভাবনা নয়, বরং ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার মুখে ফেলে আসা আপনজনের জন্য দুঃচিন্তাই বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে।
এ বছর মোট এক হাজার ৮৫০ জন গাজাবাসী হজ করতে মক্কায় এসেছেন। তাদের মধ্যে এক হাজার ৩৫০ জন মিশরে থাকেন। আর বাকি ৫০০ জন সৌদি রাজার আমন্ত্রণে এসেছেন।
তাদেরই একজন মোহাম্মেদ শিহাদ।
এই ফিলিস্তিনি হজযাত্রী জানান, হজ করার এই বিরল সুযোগকে ম্লান করে দিয়েছে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় আটকে পড়া পরিবারের সদস্যদের জীবনের আশঙ্কা।
৩৮ বছর বয়সী শিহাদ পেশায় একজন প্রকৌশলী। প্রাণঘাতি ক্যানসার রোগে আক্রান্ত তিনি। এক অর্থে বলা যায়, এই অসুস্থতাই তার জন্য হজে আসার বিরল সুযোগ এনে দিয়েছে।
শুধু এ কারণেই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে মিশরে এসে চিকিৎসা নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে।

তবে তার পরিবারের অন্য কোনো সদস্য তার সঙ্গে আসার অনুমতি পাননি।
তিনি জানান, ফেব্রুয়ারিতে গাজা ছাড়ার পর তিনি এমন এক সুযোগ পান, যা মানুষের জীবনে একবারই আসে। মিশর থেকে হজে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন তিনি।
সব প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে আগামী বুধবার থেকে শুরু হওয়া হজে তিনিও অংশ নিতে যাচ্ছেন।
তবে সৌদি আরবের মক্কা নগরীর পবিত্র স্থানগুলো পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েও শিহাদের হৃদয় ভার হয়ে আছে। তিনি সারাক্ষণ তার স্ত্রী ও চার সন্তানের কথা ভাবছেন।
ভাবছেন কীভাবে তারা ইসরায়েলের নিরবচ্ছিন্ন বিমানহামলার মধ্যেও টিকে রয়েছে।
মক্কার কাবা শরিফ অভিমুখী এক সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে এএফপির সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেন শিহাদ। তিনি বলেন, 'এটাই মানবজীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ। নিজের পরিবার থেকে এত দূরে থাকা।'
শিহাদের মতো গাজা থেকে আগত আরও হাজারো ফিলিস্তিনি এবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের লাখো হজযাত্রীর সঙ্গে যোগ দেবেন।
শিহাদ জানান, তিনি রাত-দিন গাজা যুদ্ধের অবসানের জন্য প্রার্থনা করছেন। যুদ্ধ-শেষে পরিবার পরিজনের সঙ্গে যাতে মিলিত হতে পারেন, সে কামনাই করছেন তিনি।
'আপনি বিশ্বের সেরা জায়গায় থাকতে পারেন। কিন্তু পরিবার যদি আপনার থেকে দূরে থাকে, তাহলে আপনি কখনোই সুখী হতে পারবেন না', যোগ করেন তিনি।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস। ওই হামলার পর থেকেই গাজায় নির্বিচারে প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।

দুই বার স্বল্প মেয়াদে যুদ্ধ বন্ধ থাকলেও ওই বিরতি বেশিদিনের ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে গাজা থেকে বের হয়ে আসা অসম্ভব বললেও কম বলা হয়।
হামাস-ইসরায়েলের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দ্বৈত নাগরিকত্বধারী ও অসুস্থ ব্যক্তিরাই মূলত ওই যুদ্ধবিধ্বস্ত উপত্যকা থেকে বের হয়ে আসার অনুমতি পেয়েছেন।
'এখানে আমি এখন হজের প্রস্তুতি নিচ্ছি, কিন্তু কিছু বিষয় আছে যেগুলো নিয়ে আমি কথা বলতে পারব না। যদি বলি, তাহলে আমি কাঁদতে শুরু করব', অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি এ কথা বলেন।
হামাস-ইসরায়েলের মধ্যে প্রায় দেড় মাসব্যাপী যুদ্ধবিরতি চালু থাকা অবস্থায় গাজা ছেড়ে আসেন শিহাদ।
কিন্তু এরপর থেকেই নতুন করে ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। সব ধরণের ত্রাণ প্রবেশ রুদ্ধ করে দেয় ইসরায়েল। সঙ্গে হামলার মাত্রাও বেড়ে যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গাজাজুড়ে দুর্ভিক্ষের হুশিয়ারি দিয়েছে জাতিসংঘ।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮ মার্চ থেকে নতুন করে গাজায় হামলা শুরুর পর চার হাজার ১৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৫৪ হাজার ৪১৮, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
১৮ মার্চে যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ার পর থেকেই মধ্যস্থতাকারীরা দুই পক্ষের মধ্যে নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শুক্রবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি চূড়ান্তের বিষয়টি 'একেবারে হাতের নাগালে'।

তবে এখন পর্যন্ত ওই উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি।
প্রায় দেড় বছর ধরে বারবার স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। শিহাদ বলেন, তিনি এখন আশাবাদী হতে ভয় পান। কেননা, আরও একবার হতাশ হতে চান না তিনি।
রাজাঈ রাজেহ আল-কাহলুত (৪৮) ফিলিস্তিন থেকে পালিয়ে মিশরে এসেছিলেন। ২০২৩ এ যুদ্ধ শুরুর সাত মাস পর তিনি তার চার সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যান।
ইসরায়েলি হামলায় তার বাড়ি ধ্বংস হয় এবং আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়।
সাধারণত ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জন্য হজ একটি আনন্দের উৎস। কিন্তু কাহলুত বলেন, এই পবিত্র ইবাদতে অংশ নিয়ে তিনি আনন্দের অনুভূতির কথা ভাবতেও পারছেন না।
তিনি এএফপিকে বলেন, 'আমার পরিবারের সব সদস্য, আমার ভাই-বোন, তারা সবাই গাজায়। যতক্ষণ জেগে থাকি, আমরা আমাদের পরিবারকে নিয়ে উদ্বেগে কাটাই।'
তিনি হজযাত্রীদের এই যুদ্ধের অবসান ও প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পেতে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা আহ্বান জানান।
'যুদ্ধ, মৃত্যু ও ধ্বংসের সময়ে নয়, ভালো কোনো সময়ে এখানে আসতে পারলে ভালো হোত', যোগ করেন তিনি।

মক্কার আল-নুঝা প্লাস হোটেলে গাজা থেকে আসা হজযাত্রীরা অবস্থান করছেন। ওই হোটেলের লবিতে ৬০ বছর বয়সী এক বিধবা মহিলা এএফপিকে বলেন, তিনি গত বছর চিকিৎসার জন্য গাজা থেকে বের হয়ে আসার অনুমতি পান। তখন থেকে তিনি তার ১০ সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি।
তিনি 'ফিলিস্তিনের শিশুদের' জন্য প্রার্থনা করছেন, যারা অনাহার ও সংঘাতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।
'আমি শুধু গাজার কথাই ভাবি। আমার পুরো জীবনটা সেখানে: আমার ছেলেমেয়ে, আমার বাড়ি…আমি সেখানে ফিরে যেতে চাই।'
Comments