মাহফুজ আনামের লেখা: ইসরায়েলের ‘আত্মরক্ষার অধিকার’ ও ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর নিয়তি
হামাসের নির্মম হামলায় এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হওয়ার পর 'ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে', এই যুক্তিতে বুধবার পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী ১১ হাজার ৩২০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা চার হাজার ৬৫০। গড়ে প্রতি ১০ মিনিটে একটি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপ ও ধুলার মাঝে অন্তঃসত্ত্বা নারীরা সন্তান জন্ম দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গর্ভাবস্থার শেষ সময়ে থাকা নারীরা বাস্তুচ্যুত হয়ে পথে পথে ঘুরছেন। তাদের মাথার ওপর নেই কোনো ছাদ, পান করার জন্য নেই এক চুমুক পানি। সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন কার্পেট বোমাবর্ষণে গাজা নামের উন্মুক্ত কারাগারটি এখন মৃত্যুপুরীতে রূপান্তরিত হয়েছে। কারণ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া এর বাসিন্দাদের আর কিছুই করার নেই।
কিন্তু ইসরায়েলের তো অবশ্যই 'আত্মরক্ষার অধিকার' রয়েছে!
গাজার প্রায় ২১ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১০ লাখ ইতোমধ্যে উত্তর থেকে দক্ষিণে সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করার জন্য ওই এলাকায় হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এসব মানুষ এখন গৃহহীন, সহায়সম্বলহীন, আশ্রয়হীন এবং অবশ্যই, তাদের কাছে কোনো খাবার নেই। পরাধীনতার মধ্যে থাকা অসম্মানজনক এক জীবন থেকে হঠাৎ করে সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থীতে রূপান্তরিত হয়েছেন গাজাবাসী। তাদেরকে এখন রাস্তা, পার্কে, এমনকি খোলা আকাশের নিচে হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। কেননা, ইসরায়েলের 'আত্মরক্ষার অধিকার' রয়েছে।
উত্তর গাজা নিরন্তর বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছে। সেখানে বেশিরভাগ বাড়ি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে হাজারো মানুষ বাধ্য হয়ে গাজার প্রধান হাসপাতাল আল-শিফায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই হাসপাতালে এখন ইসরায়েল সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। জাতিসংঘ বলছে সেখানে দুই হাজার ৩০০ মানুষ আটকে আছেন।
সেখানে দুর্বল ও অসুস্থ মানুষদের মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা হয়েছে। ইনকিউবেটরে শিশুরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। কারণ বিদ্যুৎ না থাকায় অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছে। কেন এই শিশুগুলোকে গাজায় জন্ম নিতে হলো? জন্মই যেন তাদের আজন্ম পাপ। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা উপকরণ না থাকায় গুরুতর অসুস্থ রোগীরা একে একে মারা যাচ্ছেন।
৯ অক্টোবর গাজা অবরুদ্ধ করার ঘোষণা দেয় ইসরায়েল। গাজায় পানি ও খাবার প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। দুই দিন পর গাজার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ১০ নভেম্বর খাবার ও পানি প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার এক মাস পূর্ণ হয়েছে। একজন মানুষ সর্বোচ্চ তিন থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত পানি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে। সুতরাং যারা পানির সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে, তারা কি চেয়েছিল গাজার ২১ লাখ মানুষ মরে যাক? আমরা এটা বিশ্বাস করতে চাই না, কিন্তু অন্য কোনো উত্তর কি আছে? গাজার বাসিন্দাদের জন্য টিউবওয়েল বসানো একটি বিকল্প হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের একটি ভৌগলিক অবস্থানে—সমুদ্র থেকে এতটা কাছে—এরকম একটি জায়গায় মাটির তলায় সুপেয় পানি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। যার ফলে, সমুদ্রের পানি পান করা তাদের হাতে থাকা অল্প কয়েকটি বিকল্পের অন্যতম।
ন্যাচারাল হিস্টোরি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ফরাসি নৌবাহিনীর এক নিরীক্ষা মতে, শুধু সমুদ্রের পানি পান করে মানুষ মাত্র ছয় দিন বেঁচে থাকতে পারে। নিঃসন্দেহে ইসরায়েলিরা এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত নয় যে, কতজন মানুষ পানিশূন্যতায় মারা গেছেন আর যারা এখনো বেঁচে আছেন, তার হয়তো অচিরেই কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে মারা যাবেন। তারপর শিশু, নবজাত ও বৃদ্ধদের কী হবে? কিন্তু এসব বিষয় ধর্তব্যে নেওয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই। কারণ যেহেতু এখনো ইসরায়েলের 'আত্মরক্ষার অধিকারের' নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি, তাই গাজাবাসীদের পানি দেওয়া যাবে না। ঠিক কি না?
ইসরায়েলের কার্পেট বোমায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাজার (জায়গাটা মাত্র ৬৫০ বর্গকিলোমিটার দীর্ঘ, প্রায় ঢাকা শহরের সমান) ভবনগুলোর ভিডিও দেখতে দেখতে মানুষের অনুভূতি ভোতা হয়ে গেছে। প্রতিদিন আমরা দেখছি বেঁচে যাওয়া মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া জীবিতদের বের করে আনার চেষ্টা করছেন। সামান্য সহায়তা পেলেও, হাজারো না হলেও শত শত মানুষকে জীবিত বের করে আনা সম্ভব হতো। কল্পনা করুন, যেসব বাবা, মা, ভাই, বোন, এমনকি শিশুরা তাদের স্বজনদের অসহায়ভাবে চোখের সামনে মারা যেতে দেখেছেন, তাদের মনের কী অবস্থা? তুলনার জন্য একটি তথ্য উপস্থাপন করা যায়—ধসে পড়া রানা প্লাজা থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। হয়তো কয়েকটি শাবল, পাথর তোলার যন্ত্র, কিছু প্রাথমিক সরঞ্জাম—একটি ক্রেন বা বুলডোজার—হয়তো হাজারো মানুষের জীবন বাঁচাতে পারত। কিন্তু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ছাড়া এ ধরনের কোনো যন্ত্র ব্যবহার করা যাচ্ছে না। হয়তো, এক গ্লাস পানি পেলে মৃত্যুপথযাত্রী একটি শিশুর অন্তিম মুহূর্তগুলো একটু সহজ হতো।
অধিকৃত পশ্চিম তীরে, যেখানে হামাসের অস্তিত্ব নেই, সেখানেও প্রতিদিন ইসরায়েলি সেনা ও দখলদার বসতি স্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে। অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা যাদের জমি জোর করে দখল করছে, তাদেরকে হত্যা করতে পারে। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদেরকে হত্যার ন্যায্যতা দিতে বলা হচ্ছে, তারাও নাকি সন্ত্রাসী অথবা সন্ত্রাসীদের সমর্থক।
দীর্ঘদিন ধরেই অমানবিক আচরণের শিকার হচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। এ কারণেই তাদের সঙ্গে ঘৃণা, অবিচার, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ও পশুর মতো আচরণ করা হচ্ছে বছরের পর বছর, সেনাসদস্য ও বসতি স্থাপনকারী ইসরায়েলিদের মনে নিশ্চয়ই এ বিষয়টি ঢুকে পড়েছে যে, ফিলিস্তিনিরা তাদের চেয়ে নিচু জাতের মানুষ এবং এ কারণে আন্তর্জাতিক আইনে মানুষকে যেসব অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তারা সেগুলোর যোগ্য নয়। এমনকি, ফিলিস্তিনি মায়েদের কোলে জন্ম নেওয়া শিশুদেরকেও মানব-শিশু হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তা না হলে, তারা কীভাবে ইনকিউবেটরের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করতে পারে?
আজ হোক অথবা আগামীকাল—আমরা চাই আজই—যুদ্ধ শেষ হবে এবং বর্বরতার অবসান ঘটবে। কিন্তু এরপর প্রশ্নবিদ্ধ হবে বিশ্ব-বিবেক। ঘৃণা, অবিশ্বাস ও সন্দেহ ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। আদর্শবাদের আরও অবক্ষয় হবে এবং আরও বেশ কিছু দেশে আদর্শের জায়গা দখল করবে ঘৃণার বেসাতি। মূল্যবোধের জায়গা দখল করবে নির্দয় ক্ষমতার জোর। লোকরঞ্জনবাদ (পপুলিজম) ও উগ্র-জাতীয়তাবাদ নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণ করবে। সেখান থেকে যুদ্ধবাজদের জন্ম হবে। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আমরা সামরিক ব্যয় বাড়তে দেখব। নিরাপত্তার নামে নাগরিকদের নজরদারির আওতায় আনা হবে এবং ভিন্নমত প্রকাশের জায়গা আরও সংকুচিত হবে। চূড়ান্ত পরিণতি হিসেবে গণতন্ত্র বিপন্ন হবে।
পাশ্চাত্যে যারা নিজেদের নৈতিকতার প্রতিভূ হিসেবে দাবি করে—তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে ফিলিস্তিনে একেকজনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমছে। তাদের মানবাধিকার ও স্বাধীনতার বুলিগুলো খুবই হালকা হয়ে যায় যখন তাদের বৈষম্য করতে দেখা যায়। ইসরায়েল প্রতিটি আন্তর্জাতিক আইন যথেচ্ছভাবে লঙ্ঘন করছে, যা পশ্চিমাদের অবস্থানকে আরও নড়বড়ে করছে। আর ইসরায়েলকে যে অবস্থানে রাখা হয়েছে, তাতে প্রমাণিত হয় যে এমন কোনো আন্তর্জাতিক আইন, নীতি বা মানবিক মূল্যবোধ নেই যা সব মানুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
আমরা কি এমন এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি, যেখানে সভ্যতার মূল্যবোধ নয়, বরং বন্দুকের নলই সবকিছু নির্ধারণ করবে? নীতি-নৈতিকতা ছুড়ে ফেলে ইসরায়েল যে ক্ষমতার পূজা করছে, সেখানে আমরা প্রতিদিন এটাই দেখতে পাচ্ছি।
আর এমনটা হলে আমাদের এখন এই অর্থহীন কথাবার্তা বন্ধ করা উচিত। কারণ, ইসরায়েলকে তাদের 'আত্মরক্ষার অধিকার' দিতে হবে।
মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার
ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments