ইরান-ইসরায়েল সংঘাত: যা ঘটল ৭ বছরে

ইসরায়েলি হামলার পর তেহরানের ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবন। ১৩ জুন ২০২৫। ছবি: রয়টার্স

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার দীর্ঘদিনের 'গোপন' সংঘাত এবার তীব্রভাবে প্রকাশ্যে ফিরে এসেছে।

গতকাল শুক্রবার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে বড় হামলা চালায়। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে তেহরান।

এই হামলার ঘটনায় আশঙ্কা দেখা দিয়েছে যে, সামরিক দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী ইসরায়েল অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইরানের মধ্যে চলমান এই উত্তেজনা পূর্ণ যুদ্ধের রূপ নিতে পারে।

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতের সাম্প্রতিক ইতিহাস তুলে ধরেছে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস।

২০১৯: ইরানের মিত্রদের ওপর হামলা

ইসরায়েল সিরিয়া, লেবানন ও ইরাকে ইরানের মিত্রদের ওপর একাধিক হামলা চালায়। ইসরায়েলের দাবি—ইরান যাতে মিত্রদের অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করতে না পারে, সেজন্যই এই ধারাবাহিক হামলা।

ইসরায়েলের অভিযোগ—ইরাক ও সিরিয়ার ভেতর দিয়ে লেবাননে অস্ত্র সরবরাহের পথ তৈরির চেষ্টা করছিল ইরান। লেবাননে হিজবুল্লাহকে দীর্ঘদিন ধরেই ইরান সমর্থন দিয়ে আসছে।

এ ছাড়াও, পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্য দিয়ে ইরানের তেল ও অস্ত্রবাহী জাহাজেও হামলা চালায় ইসরায়েল।

২০২০: দূর-নিয়ন্ত্রিত হত্যাকাণ্ড

২০২০ সালের নভেম্বরে দূর-নিয়ন্ত্রিত মেশিনগানের মাধ্যমে ইরানের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যা করে ইসরায়েল।

২০২১: সমুদ্রে সংঘাত

সাগরে একে অপরের ওপর হামলা বাড়িয়ে দেয় ইরান ও ইসরায়েল।

সে বছর ফেব্রুয়ারিতে ওমান উপকূলে যানবাহন বহনকারী ইসরায়েলি মালিকানাধীন জাহাজে বিস্ফোরণের পেছনে ইরানকে দায়ী করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনয়ামিন নেতানিয়াহু। অন্যদিকে, মার্চে ইরান অভিযোগ করে—ইসরায়েল তাদের কার্গো জাহাজে হামলা চালিয়েছে। এটি ইসরায়েলের উপকূল থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরে ছিল।

এরপর এপ্রিলে লোহিত সাগরে থাকা ইরানি সামরিক জাহাজ ইসরায়েলি মাইন হামলায় বিধ্বস্ত হয়। পাল্টাপাল্টি এমন ঘটনা বছর ধরেই চলতে থাকে।

২০২২: ইরানি কর্মকর্তাকে হত্যা করে ইসরায়েল

মে মাসে মোটরসাইকেলে আসা দুই আততায়ী ইরানের বিপ্লবী গার্ড (আইআরজিসি) কর্মকর্তা কর্নেল সাইয়াদ খোদাইকে গুলি করে হত্যা করে।

ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি—সাইয়াদ খোদাই গোপন অভিযান দলের নেতৃত্ব দিতেন। এই দলটি হত্যাকাণ্ড ও অপহরণ পরিচালনা করত। ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই হত্যাকাণ্ডে নিজেদের ভূমিকার কথা নিশ্চিত করে।

দুই বিজ্ঞানীর মৃত্যু

মে মাসেই মারা যান দুই বিজ্ঞানী।

অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আইয়ুব এনতেজারি কাজ করতেন সামরিক গবেষণা কেন্দ্রে এবং কামরান আগামোলাই ছিলেন ভূতত্ত্ববিদ। তারা খাবারে বিষক্রিয়ার লক্ষণ নিয়ে মারা যান।

ইরান অভিযোগ করে—ইসরায়েল তাদের বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল মন্তব্য করেনি।

২০২৩: সংঘাতে উত্তপ্ত মধ্যপ্রাচ্য

৭ অক্টোবরের হামলা: হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলার পর গাজায় ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়। হামাসের প্রতি সংহতি জানিয়ে লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুতিসহ এই অঞ্চলের ইরান-সমর্থিত অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়।

যদিও ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ৭ অক্টোবরের হামলায় ইরানের ভূমিকা থাকার কথা নাকচ করেন। তবে হামাস নেতারা আঞ্চলিক মিত্রদের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার কথা জানান।

সিরিয়ায় বিমান হামলা: ডিসেম্বরে সিরিয়ায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করে তেহরান।

২০২৪: দামেস্কে হামলা ও একাধিক পাল্টা হামলা

এপ্রিলে সিরিয়ার দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি বিমান হামলায় ইরানের তিন শীর্ষ কমান্ডার ও চারজন কর্মকর্তা নিহত হন। এর কয়েক সপ্তাহ পর তেহরান ইসরায়েলের দিকে ৩০০টিরও বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। এগুলোর প্রায় সবই ভূপাতিত করা হয়। এর পরপরই, ইসরায়েল ইরানের বিমানবিধ্বংসী ব্যবস্থায় হামলা চালায়। এটি একটি পারমাণবিক স্থাপনাকে সুরক্ষা দিচ্ছিল।

তেহরানে ইসমাইল হানিয়াহ হত্যা

জুলাইয়ে হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াহ তেহরানের বিপ্লবী গার্ডের এক গেস্টহাউসে বিস্ফোরণে নিহত হন। পরে ইসরায়েল নিশ্চিত করে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে তাদের হাত ছিল।

পেজার হামলা

সেপ্টেম্বরে লেবাননে চালানো পেজার হামলায় ইরানের রাষ্ট্রদূত মোজতবা আমিনি এক চোখ হারান। হিজবুল্লাহ সদস্যদের লক্ষ্য করে হামলাটি চালানো হয়েছিল। একই হামলায় অনেকে নিহত ও হাজারো মানুষ আহত হন। ইসরায়েল পরে নিশ্চিত করে যে তারা এসে হামলা চালিয়েছিল।

হিজবুল্লাহ প্রধান নিহত

সেপ্টেম্বরে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের কাছে বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করে ইসরায়েল।

ইসরায়েলে ইরানের ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র

অক্টোবরে ইসরায়েলে প্রায় ১৮০টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ইরান। নাসরাল্লাহ, হানিয়াহ ও এক ইরানি কমান্ডারের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হিসেবে সেই হামলা চালানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্রই ইসরায়েল প্রতিহত করে।

ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে লক্ষ্য করে হামলা

অক্টোবরের শেষদিকে ইসরায়েল ইরানে বিমান হামলা চালায়। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো রক্ষায় ব্যবহৃত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়।

ইরান ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন—এপ্রিল ও অক্টোবরের হামলাগুলোয় রাশিয়া থেকে কেনা ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। এর মধ্যে ইরানের মধ্যাঞ্চলের এক খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ছিল। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সুরক্ষায় এটি ব্যবহার কার হতো।

২০২৫: দীর্ঘ হামলার শুরু

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা দেন। এ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা কয়েক মাস আলোচনা করেন। পরে এপ্রিলে ট্রাম্প কূটনৈতিক পথ বেছে নেন। তিনি যুদ্ধ নয়, আলোচনার সিদ্ধান্ত নেন।

সম্প্রতি ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করবে না বলে জানায়। তবে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলতে পারে বলে মত দেয়।

গত ১২ জুন ট্রাম্প বলেন, ইসরায়েল ইরানে হামলা করলে আলোচনা ভেস্তে যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, 'আমার মনে হয় এটা সব শেষ করে দেবে।' তবে এও যোগ করেন, 'আসলে হয়তো এটা সাহায্যও করতে পারে। কিন্তু, এটা সবকিছু নষ্টও করে দিতে পারে।'

Comments

The Daily Star  | English

Patent waiver till Nov 2026: Local pharmas may miss window for 15 costly drugs

Bangladesh’s pharmaceutical companies risk losing the chance to produce at least 15 costly biologic drugs royalty-free

8h ago