নিজের নাক কেটে কি অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করবে ইরান
ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের চলমান সংঘাতের মধ্যে সম্প্রতি ইরানের প্রভাবশালী আইনপ্রণেতা ইসমাইল কোসারি দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আইআরআইএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তারা 'বিশ্ব জ্বালানির লাইফলাইন' হিসেবে পরিচিত হরমুজ প্রণালি বন্ধের বিষয়টি বিবেচনা করছেন।
বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহের জন্য কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালি দিয়ে সারা পৃথিবীর প্রায় এক পঞ্চমাংশ অপরিশোধিত তেল পারাপার হয়।
ইরানসহ সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও বাহরাইনের মতো প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো তাদের পণ্য এই পথ দিয়েই রপ্তানি করে।
নিকট অতীতে ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞার জবাবে ইরান এই প্রণালি বন্ধের হুমকি দিয়েছিল। এর আগে গত শতকের আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরান এই প্রণালিতে মাইন পাতে এবং বেশ কয়েকটি তেলবাহী জাহাজে হামলা চালায়।
এর ভেতর ১৯৮৭ সালে হরমুজ প্রণালিতে একটি মাইন মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস স্যামুয়েল বি. রবার্টস-এ আঘাত হানলে তা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান প্রেক্ষাপটে ইরান প্রণালিটি বন্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করলে তা যে কেবল জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা তৈরি করবে তা-ই নয়, এর ফলে এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই।
এর পাশাপাশি ইরান নিজেও যেহেতু এই প্রণালি ব্যবহার করে জ্বালানি রপ্তানি করে, সেহেতু এই পথ বন্ধ করলে যুদ্ধের ভেতর তাদের নিজস্ব অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এখন প্রশ্ন হলো—ইরান কি নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে চাইবে?

হরমুজ প্রণালির অবস্থান
হরমুজ প্রণালির অবস্থান পারস্য ও ওমান উপসাগরের মধ্যে। এ প্রণালি পারস্য উপসাগরকে সরাসরি ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সেই পথ ধরে জাহাজগুলো আরব সাগরে তথা ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে।
আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, এটাকে ইরান ও ওমানের মধ্যে অবস্থিত একটা চ্যানেল বা খাল বলা চলে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে জায়গাটির আনুমানিক দূরত্ব তিন হাজার ৪১৮ কিলোমিটার।
এই প্রণালিতে ঢোকা ও বের হওয়ার পথটি প্রায় ৫০ কিলোমিটার প্রশস্ত। তবে মধ্যবর্তী জায়গায় এর সবচেয়ে সংকীর্ণ অংশটির প্রশস্ততা আরও কম; ৪০ কিলোমিটার। কিন্তু, এর মধ্যবর্তী অংশ বড় জাহাজ চলাচলের জন্য যথেষ্ট গভীর।
দৈনিক কী পরিমাণ জ্বালানি যায় এই প্রণালি দিয়ে
যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (ইআইএ) তথ্য বলছে, এই প্রণালি দিয়ে ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ব্যারেল তেল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য প্রায় ৬০ হাজার কোটি ডলারের সমতুল্য।
ইআইএ এই প্রণালিকে 'বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন পথ' হিসেবেও অভিহিত করেছে। সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের মোট জ্বালানি তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ এই পথ দিয়ে যায়।

প্রণালি বন্ধের প্রভাব
বিশ্বখ্যাত মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মর্গানের বিশ্লেষকরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ করা হলে তা ইরানের অর্থনীতির জন্য 'বুমেরাং' হবে। কারণ ইরান এই জলপথে পণ্যের অবাধ চলাচলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাই এই এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে তা ইরানের জন্য হবে 'আত্মঘাতী'।
বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এই জলপথের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রায় প্রায় ৩০০ কোটি লিটার জ্বালানি সরবরাহ হয়। এর ৮০ শতাংশেরও বেশি যায় চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে।
রয়টার্স, আল জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করলে চীন ও রাশিয়ার মতো ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সমর্থনও হারাতে পারে। কারণ এই দেশগুলোও চায় না যে হরমুজ বন্ধ হোক।
এ ছাড়াও, ইরান এই প্রণালি বন্ধ করলে যুক্তরাষ্ট্র বা এর মিত্র দেশগুলো সামরিক ব্যবস্থা নিতে পারে। কারণ, তারা ওই অঞ্চলের বাণিজ্যিক জাহাজ রক্ষার দায়িত্বে আছে।
পাশাপাশি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বিশ্বজুড়ে এর ব্যাপক ও মারাত্মক অভিঘাত তৈরি হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এসব প্রতিবেদনে। যেহেতু বিশ্বের মোট জ্বালানি সরবরাহের বড় অংশ এই পথেই যায়, সেহেতু এটি সরাসরি বিশ্ব অর্থনীতির ওপর। এমনকি, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপরও আক্রমণ বলে বিবেচিত হতে পারে।
এর ফলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি খাদ্য, পোশাক ও অন্যান্য নিত্য পণ্যের দামও বেড়ে যেতে পারে। বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতি।
এর বাইরে এমন কোনো পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গেও ইরানের সম্পর্ককে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। আরও তীব্র হতে পারে আঞ্চলিক সংঘাত। বিশ্ব রাজনীতিতেও তৈরি হতে পারে বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা।
এমন কিছু হলে বাংলাদেশেরও এই প্রভাবের বাইরে থাকার কারণ নেই। অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়লে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় চাপ পড়বে। এর বোঝা সাধারণ জনগণের ওপরেই পড়বে।
সামগ্রিকভাবে, গণমাধ্যমগুলো হরমুজ প্রণালির সম্ভাব্য বন্ধের বিষয়টিকে গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখছে। এটি বিশ্ব অর্থনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় সংকট তৈরি করতে পারে।

হরমুজ প্রণালি ও ইরাক-ইরান যুদ্ধ
গত শতকের আশির দশকে আট বছর ধরে চলা ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলাকালে হরমুজ প্রণালি উভয় পক্ষের জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত ক্ষেত্র। এই যুদ্ধ 'ট্যাংকার যুদ্ধ' নামেও পরিচিত। কারণ এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই একে অপরের তেলবাহী ট্যাংকারগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল। সে সময়ে ইরান হরমুজ প্রণালিতে মাইন পেতে বেশ কয়েকটি তেলবাহী জাহাজে হামলা চালায়।
এর প্রতিক্রিয়ায় হরমুজ প্রণালি দিয়ে তেল পরিবহনে বিঘ্ন ঘটায় বিশ্ববাজারে তেলের দাম নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায় ও বিশ্ব বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। সৌদি আরব, কুয়েত ও আমিরাতের মতো উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক চরম অবনতির দিকে চলে যায়।
বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে ইরানের জলসীমা এড়ানোর পরামর্শ
গতকাল বুধবার রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাত আরও বৃদ্ধির আশঙ্কায় বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে ওমানের কাছাকাছি দিয়ে ও ইরানের জলসীমা এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দিয়েছে সামুদ্রিক সংস্থাগুলো।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রণালি বন্ধ হলে বাণিজ্য সীমিত হতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে সর্বশেষ ব্যবস্থা হিসেবে হরমুজের দিকে যাত্রা করা জাহাজগুলো ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছে জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশিরভাগ জাহাজ যাত্রাপথে ওমান উপকূলের কাছাকাছি দিয়ে চলাচল করছে।
এদিকে গ্রিসের শিপিং মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার বিবৃতিতে বলেছে, 'অতীতে ইরানের উপকূলে বাণিজ্যিক জাহাজের নেভিগেশনের স্বাধীনতা ও সামুদ্রিক সুরক্ষার লঙ্ঘন ঘটনার কথা বিবেচনা করে আমরা দৃঢ়ভাবে পরামর্শ দিচ্ছি যে, যদি সম্ভব হয় গ্রিক পতাকাবাহী জাহাজগুলো পারস্য উপসাগর, হরমুজ প্রণালি ও ওমান উপসাগরে ইরানের এখতিয়ারভুক্ত জলসীমার দূর থেকে চলাচল করবে।'
কাতার এনার্জিও তাদের ট্যাংকারগুলোকে হরমুজ প্রণালির বাইরে থাকতে এবং কেবল জ্বালানি ভরার আগের দিন উপসাগরে ঢোকার নির্দেশ দিয়েছে।
Comments