গাজা: এবার ত্রাণকেও ‘অস্ত্র’ বানাচ্ছে ইসরায়েল

এক বছর আট মাসেরও বেশি সময় ধরে চালানো ইসরায়েলের সর্বাত্মক হামলায় ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ উপত্যকা গাজা এখন কার্যত ধ্বংসস্তূপ।
এ সময়ের মধ্যে সেখানে নিহত হয়েছেন ৫৫ হাজারের বেশি মানুষ। শিশুদের দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়েছে। গোটা পরিবারকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে একের পর এক হাসপাতাল, আশ্রয়কেন্দ্র।
নির্বিচার হামলার শুরুর দিকেই ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় খাবার, পানি ও জ্বালানি সরবরাহে বাধা দিতে থাকে। ইচ্ছা করেই উপত্যকাটিতে মানবিক সহায়তার প্রবেশ ঠেকিয়ে দেয়। তছনছ করে দেয় কৃষিজমি। বেঁচে থাকার জন্য যা যা জরুরি, তা থেকে বঞ্চিত করা হয় সাধারণ মানুষকে। তৈরি করা হয় দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি।
এমন পরিস্থিতিতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) বলে, দখল করা গাজায় বেসামরিক মানুষকে ক্ষুধার মুখে ফেলাকে যুদ্ধের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরায়েল।
এদিকে, আজ রোববার টানা দশম দিনের মতো ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত ১৩ জুন থেকে ইসরায়েলের নজিরবিহীন হামলার জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। অনেকের ধারণা ছিল, ইরানে হামলার কারণে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার তীব্রতা কমবে। কিন্তু এই ১০ দিনেও গাজায় ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন কয়েক শ ফিলিস্তিনি।
এসব হামলার অনেকগুলোই ঘটেছে ত্রাণের খোঁজে আসা ক্ষুধার্ত, দুর্বল ফিলিস্তিনিদের ওপর।
দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার আগেই গত ২ মার্চ থেকে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে প্রায় তিন মাস পর মে মাসের শেষ দিকে কিছু ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেয়; কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোকে বাদ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামে সংগঠন তৈরি করে এর মাধ্যমে গাজার অল্প কিছু জায়গায় ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।
এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই জিএইচএফ'র বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে—এবার কী ত্রাণকেও অস্ত্র বানাচ্ছে ইসরায়েল?
সর্বশেষ গতকাল শনিবার গাজায় ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১১ জনই ছিলেন ক্ষুধার তাড়া খেয়ে জিএইচএফ'র ত্রাণ নিতে আসা মানুষ।
জাতিসংঘও জিএইচএফ'কে 'ত্রাণ সহায়তাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার' নিন্দা জানিয়েছে।
আলজাজিরা, রয়টার্স, সিএনএন, বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত শুক্রবারও গাজার কয়েকটি জায়গায় বিমান হামলার পাশাপাশি ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। মধ্য গাজার নেতজারিম করিডরে ত্রাণ নিতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করলে ৩৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হন। এ ছাড়া দেইর আল–বালায় ইসরায়েলের বোমা হামলায় নিহত হন অন্তত আটজন।
ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হামলার পর মধ্য গাজার আল–আওদা হাসপাতালের মেঝেতে মরদেহ ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। হাসপাতালটির এক মুখপাত্রও জানান, অর্ধাহারে–অনাহারে থাকা হাজারো ফিলিস্তিনি যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত জিএইচএফ'র বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় তাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি সেনারা গুলি করলে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।
গাজার গণমাধ্যম কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, গত মে মাসের শেষ দিক থেকে ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হয়েছেন চার শর বেশি ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার মানুষ।
দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার আগেই গত ২ মার্চ থেকে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল। আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে প্রায় তিন মাস পর মে মাসের শেষ দিকে কিছু ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
এক্ষেত্রে বাদ দেওয়া হয় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থাগুলোকে। জিএইচএফ'র মাধ্যমে গাজার অল্প কয়েকটি জায়গায় ত্রাণ দেওয়া শুরু হয়। এর পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই জিএইচএফ'র বিতরণকেন্দ্রে ত্রাণ নিতে আসা ফিলিস্তিনিদের গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

এর ভেতর আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন (এফএফসি) পরিচালিত ত্রাণবাহী জাহাজ 'ম্যাডলিন'কেও গাজায় ভিড়তে দেয়নি ইসরায়েল। ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য ইতালি থেকে জাহাজটিতে করে ত্রাণ নিয়ে আসা হচ্ছিল।
গত ৯ জুন আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকেই জাহাজটিকে ইসরায়েলের আশদাদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়। আটক করা হয় সুইডেনের পরিবেশবিষয়ক আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ ১২ মানবাধিকারকর্মীকে।
গত বৃহস্পতিবার ত্রাণ নিতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ২৩ ফিলিস্তিনি নিহত হন। এর আগে বুধবার ২৯ জন ও মঙ্গলবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে ত্রাণ নিতে গেলে ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলের সেনারা।
তারও আগে সোমবার রাফায় ৩৮ জন ও এর আগে রোববার দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় ত্রাণ নিতে গেলে ১৭ ফিলিস্তিনিকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এর ভেতর গত শুক্রবার মধ্য-গাজার দেইর আল-বালাহ থেকে আলজাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজ্জুম জানান, ত্রাণকেন্দ্রে হামলা এখন যেন 'প্রতিদিনের রুটিনে' পরিণত হয়েছে।
ওই প্রতিবেদক বলেন, 'তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সীমান্ত ক্রসিংগুলোয় ইসরায়েলের পূর্ণ অবরোধ গাজাকে ক্ষুধার কেন্দ্রে পরিণত করেছে। সেখানে সব ধরনের মানবিক সরবরাহ ফুরিয়ে গেছে। এখন তাদের বাধ্য করা হচ্ছে নির্দিষ্ট ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে যেতে; এক বস্তা আটা, বোতলজাত পানি ও খাবারের বাক্স সংগ্রহ করার জন্য।'
বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে আবু আজ্জুম আরও জানান, প্রয়োজনের তুলনায় জিএইচএফ যে পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করছে, তার পুষ্টিমানও অতি নিম্ন।
ওই সংবাদকর্মীর পর্যবেক্ষণ হলো, এই মুহূর্তে গাজার সমস্ত মানবিক করিডর বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে।
এ সংক্রান্ত রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রমাণ ছাড়াই ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে—ত্রাণ নিতে আসা মানুষের ভেতর 'সন্দেহভাজনরা' তাদের দিকে এমনভাবে তেড়ে আসে যে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হয়।

গত শুক্রবার দির আল-বালাহ থেকে আলজাজিরার আরেক প্রতিবেদক হিন্দ খৌদারি জানান, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোয় হামলা গাজার 'ক্রমবর্ধমান খারাপ' পরিস্থিতির প্রমাণ। এটি খাবারের জন্য ফিলিস্তিনিদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে বাধ্য করছে।
হিন্দ খৌদারির ভাষ্য, প্রতিদিন গাজায় খুব সীমিত সংখ্যক ত্রাণের ট্রাক ঢুকছে। ক্ষুধার্ত মানুষ অত্যন্ত মরিয়া হয়ে সেখান থেকে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করতেই গুলি খেয়ে মরছে।
বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সম্মিলিত বার্তা হলো—গাজায় ত্রাণকেন্দ্রে হামলা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। তারা এই অমানবিক পরিস্থিতি বন্ধ করতে, মানবিক সহায়তা অবাধে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে ও এই হামলায় দায়ীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে জোরালো আহ্বান জানিয়েছে।
ফ্রান্সভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য চিকিৎসা সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস'র (এমএসএফ) প্রধান ক্রিস্টোফার লকইয়ার যেমন বলেছেন, গাজায় কেবল জিএইচএফ'র মাধ্যমে 'বাধ্যতামূলক ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থা' শুধু একটি ব্যর্থতা নয়, বরং 'অমানবিক ও বিপজ্জনক'।
অন্যদিকে, গাজার ত্রাণ বিতরণকেন্দ্র ও এর আশপাশের এলাকায় বেসামরিক লোকজনের ওপর এমন প্রাণঘাতী হামলাকে 'যুদ্ধাপরাধ' হিসেবে অভিহিত করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। নিরীহ মানুষদের ওপর চালানো 'মারাত্মক হামলা'কে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, 'গাজার ক্ষুধার্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ যখন অল্প পরিমাণে আসা খাদ্য সহায়তা নিতে যাচ্ছে, তখন তাদের ওপর চালানো প্রাণঘাতী হামলা মর্মান্তিক ও অমানবিক।'
প্রশ্ন হলো—গাজার চলমান গণহত্যা কিংবা বিনা উসকানিতে ইরানে হামলার ক্ষেত্রে কোন আন্তর্জাতিক আইনের ধার ধেরেছে ইসরায়েল? এক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর নিন্দা-প্রতিবাদে তাদের কী-ই বা আসে-যায়?
Comments