মাস্ক ভক্তদের নতুন তীর্থ ‘টেসলা ডাইনার’

সাম্প্রতিক সময়ে হলিউডের পশ্চিমে একটি গোলাকৃতির রুপালি রঙের ভবন সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। সান্তা মনিকা বুলেভার্ড ও অরেঞ্জ ড্রাইভের মোড়ে অবস্থিত এই নবনির্মিত, সুবিশাল ভবনের নাম 'টেসলা ডাইনার'।
হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই ধরেছেন। ধনকুবের ইলন মাস্কের বিদ্যুৎচালিত গাড়ি টেসলার সঙ্গে এই রেস্তোরাঁর যোগসূত্র রয়েছে। গত জুলাইতে দুই তলা বিশিষ্ট রেস্তোরাঁটির উদ্বোধন হয়।
এতে সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি ইলেকট্রিক গাড়ি চার্জিং স্টেশন, ড্রাইভ-ইন থিয়েটার (নিজের গাড়িতে বসে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার সুযোগ) ও বিভিন্ন ধরনের টেসলা পণ্য কেনার সুবিধা রয়েছে।

এক কথায় বলতে গেলে, টেসলা ডাইনার পরিদর্শন করে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারার সুযোগ পাচ্ছেন মাস্ক-ভক্তরা।
স্বভাবতই, এই অভিনব রেস্তোরাঁ ইলন মাস্ক ও তার একাধিক প্রতিষ্ঠানের অগুনতি ভক্তের 'তীর্থস্থান' হিসেবেও দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
সাত বছরের প্রকল্প
ইলন মাস্কের অপর নাম যেন 'বিতর্ক'। কারণে অকারণে, ইতিবাচক বা নেতিবাচক ঘটনায় বারবার তার নাম গণমাধ্যমে আসে। তা সত্ত্বেও, বিশ্বজুড়ে মাস্কের ভক্ত-সমর্থকদের যেন কোনো কমতি নেই।
২০১৮ সালে এই অভিনব রেস্তোরাঁ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেন মাস্ক। তবে নির্মাণকাজ শুরু হতেই লেগে যায় পাঁচটি বছর।
এই ডাইনার চালু হতে হতে মাস্ক ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

২০২২ সালে টুইটার (বর্তমানে এক্স) কিনে নেওয়া, ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও পরবর্তীতে তা তিক্ততায় রূপ নেওয়া, ডোজের প্রধান হিসেবে নিন্দা কুড়ানো, নতুন রাজনৈতিক দল তৈরির ঘোষণা কিংবা টেসলার শেয়ারে দরপতন ও গাড়ি বিক্রি কমে যাওয়ার মতো বড় বড় ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছেন মাস্ক।
কিন্তু ডাইনারে নৈশভোজ করতে আসা ভোক্তাদের কাছে মাস্কের রাজনৈতিক পরিচয়, ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন বা টেসলার সংগ্রাম—এগুলোই কিছুই তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।
কল্পবিজ্ঞানের গল্পের আদলে নির্মিত ডাইনার
টেসলার সাইবারট্রাক গাড়িটি দেখলে মনে হয় এটা যেন কল্পবিজ্ঞানের গল্পের বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা একটি অটোমোবাইল। অনেকে ভবিষ্যত পৃথিবীর কাল্পনিক রূপ নিয়ে তৈরি হানা বারবেরার কার্টুন 'দ্য জেটসনস' এর সঙ্গে এর তুলনা দিয়েছেন।
মজার বিষয় হলো, টেসলা ডাইনারে প্রায় সব উপকরণেই সাইবারট্রাকের মতো ভবিষ্যতমুখী নির্মাণশৈলী ও নকশার নিদর্শন আছে।
ডাইনারটিকে ঘিরে রেখেছে ৮০টি সুপারচার্জার স্টেশন। এগুলোতে গাড়ি চার্জ করতে দিয়ে টেসলার টাচ স্ক্রিন ব্যবহার করে ভোক্তারা খাবারের অর্ডার করতে পারবেন। পাশাপাশি, গাড়ির অডিও সিস্টেম সরাসরি ডাইনারের ড্রাইভ ইন থিয়েটারের সাউন্ড সিস্টেমের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।

যার ফলে, সিনেমার ডায়লগ ও অন্যান্য শব্দ শুনতে আপনাকে গাড়ির জানালাও খোলা লাগবে না। গাড়িতে বসেই, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সিনেমা উপভোগ করতে পারবেন।
৬৬ ফুট দীর্ঘ এলইডি মেগাস্ক্রিন স্কাইপ্যাডে বসে বা টেসলার গাড়ির কেবিন থেকে 'টেসলা ডাইনার অ্যাপ' ব্যবহার করে সিনেমা দেখা যাবে। কবে কোন সিনেমা দেখানো হবে, তার বিস্তারিত টেসলার টাচস্ক্রিণ চেপেই জানা যায়।
ডাইনারের ভেতরে যা আছে
বেশিরভাগ ভোক্তা বাইরে নয়, বরং রেস্তোরাঁর ভেতরে বসে খাবার উপভোগ করতে পছন্দ করেন। সেটার জন্য একটি গোলাকার প্রবেশপথ ধরে আগাতে হয়। কিছুদূর আগালে বক্রাকৃতির কাউন্টার, ওভাল আকৃতির বুথ ও গোলাকার চেয়ার চোখে পড়বে। সবকিছুই ধাতব রুপালি, সাদা বা কালো রঙে রাঙানো। একটি সর্পিল আকৃতির সিঁড়ি আপনাকে দোতলার 'স্কাইপ্যাড' রুফটপে নিয়ে যাবে। সিঁড়িটি টেসলার অপটিমাস অটোনোমাস রোবটের বিভিন্ন সংস্করণের মডেল দিয়ে সজ্জিত।

স্কাইপ্যাডে টেসলা ও অপটিমাস ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হয়। এর মধ্যে আছে অন্যতম জনপ্রিয় পণ্য ৩৫ ডলারের টেসলা গামি ক্যান্ডি। স্কাইপ্যাডে বসে ভোক্তারা বিশাল স্ক্রিনে সিনেমা উপভোগ করতে পারেন। পাশাপাশি হলিউডের বিভিন্ন দৃশ্য দেখার জন্যেও এটি উপযুক্ত।
রোবট ওয়েটার
ডাইনারের শুরুর দিকে ওয়েটারের ভূমিকায় ছিল অপটিমাস রোবট। তারা স্কাইপ্যাডে পপকর্ণ পরিবেশন করতো। তবে কর্মীরা জানান, গত কয়েক মাস ধরে ওই রোবটগুলো বিকল হয়ে পড়ে আছে। তা সত্ত্বেও, রেস্তোরাঁর সাজসজ্জায় ওই রোবটের বিভিন্ন মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। রুফটপের খুচরা দোকানেও রোবটের ছবি সম্বলিত টি-শার্ট, টেসলা বট অ্যাকশন ফিগার ও অন্যান্য স্মারক বিক্রি হচ্ছে।

বিশেষায়িত খাবারের মেনু
টেসলা ডাইনারের ওয়েবসাইটে যেয়ে খাবারের মেনুতেও অভিনবত্বের ছাপ পাওয়া যায়। জনপ্রিয় আইটেমের মধ্যে আছে বিশেষ ও আকর্ষণীয় 'টেসলা বার্গার'। পাশাপাশি মার্কিনিদের প্রথাগত পছন্দের খাবার হট ডগ, মিল্কশেক, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস, অ্যাপল পাই, সালাদ কিংবা নানা ধরনের স্যান্ডউইচও আছে মেনুতে।
বিশাল আকারের টেসলা বার্গারের দাম ধরা হয়েছে সাড়ে ১৩ মার্কিন ডলার। এটি তৈরিতে এক পাউন্ড মাংসের তিন ভাগের এক ভাগ ব্যবহার হয়।

তবে উদ্বোধনের সময় খাবারের মেনুতে থাকা কিছু আইটেম এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। সিএনএনের প্রতিনিধিরা আগস্টে সেখানে গেলে শুরুর দিকের জনপ্রিয় খাবার 'এপিক বেকন' খুঁজে পাননি।
মাস্ক ভক্তরা অবিচল
টেসলা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ঝামেলায় জড়িয়ে থাকলেও এতে মাস্কভক্তরা একটুও বিচলিত নন।
টেসলা ফ্যানরা নিয়মিত টেসলা ডাইনারে সমবেত হয়। সাইবারট্রাক মালিকরা নিয়মিত সেখানে নিজেদের উদ্যোগে জমায়েত হয়ে 'লাইট শো'র আয়োজন করেন। সারিবদ্ধ সাইবারট্রাকগুলো ডাইনারে চলতে থাকা গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হেডলাইট অন-অফ করে এই লাইট শোর আয়োজন করেন। দর্শনার্থীদের বয়ান, এই প্রদর্শনী একইসঙ্গে চিত্তাকর্ষক ও অভিনব।

গত মঙ্গলবার মাস্কের স্পেস এক্স স্টারশিপের প্রথম ফ্লাইট উপভোগ করতে টেসলা ভক্তরা ডাইনারে জমায়েত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে রওনা হয়ে একইদিন ভক্তদের টেসলা ডাইনারে এসে পৌঁছানোর মতো অনুষ্ঠানেরও তথ্য পাওয়া গেছে।
মাস্কের অসাধ্য কিছুই নেই
সম্প্রতি ফ্লোরিডা থেকে টেসলা ডাইনে খেতে আসেন জ্যাকব টোউ।
তিনি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, মাস্ক হচ্ছেন বিশ্বের এক বিরল প্রতিভা।
টোউ বলেন, 'মাস্ক জনগণের অভিমতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করতে পারেন—যা একইসঙ্গে তার গুণ এবং দোষ। বিষয়টি বিনোদনমূলক। আর কিছুই নয়।'
'মাস্ক হচ্ছেন শতভাগ ডেটা ভিত্তিক একজন মানুষ। ডেটা যা বলে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ—অন্য সব কিছু তার কাছে অর্থহীন', বলেন তিনি।

তিনি মাস্কের রাজনীতি আসার বিষয়টিও ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন। ট্রাম্পের সঙ্গে 'ঝামেলার' পর মাস্কের নতুন দল গঠনের পরিকল্পনার বিষয়ে টোউ বলেন, 'তিনি আমার শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। এটা কঠিন পথ বেছে নেওয়ার উদাহরণ।'
'সবাই যখন কোনো একটি কিছু করতে নিষেধ করবে, সেটাই তখন মাস্ক করে দেখাবেন। যখন কোনো কিছুকে অসাধ্য বলে মনে হবে, অনেক খরুচে মনে হবে—ঠিক সেগুলোই মাস্ক করে দেখাবেন। কোনো না কোনোভাবে মাস্ক এটা করে দেখাবেন বা কিভাবে করতে হবে সেটা বের করবেন, আর সেই উদ্যোগ থেকে অর্থও উপার্জন করে নেবেন', যোগ করেন মাস্ক-ভক্ত টোউ।
Comments