চীনে সফরে কিমের ‘প্রিয় কন্যা’, জু অ্যায় কি উ. কোরিয়ার পরবর্তী নেতা

উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন বর্তমানে বেইজিং সফরে আছেন। এই সফরে উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র চীন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করবেন কিম। তবে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, তার এই সফরের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো, মেয়েকে সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে পরিচয় করানো।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কিমের মেয়ে কিম জু অ্যায়ে বেইজিং সফরে বাবার সঙ্গে ছিলেন। সেখানে বুধবার তিনি ২০টির বেশি দেশের নেতার সঙ্গে সামরিক কুচকাওয়াজে যোগ দেন। মঙ্গলবার বিশেষ ট্রেনে কিমের সফরসঙ্গীরা বেইজিং রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছান। পরে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, জু অ্যায়ে কিমের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তখন চীনের শীর্ষ কর্মকর্তারা কিমকে স্বাগত জানান।
জু অ্যায়ের বয়স আনুমানিক ১২ বছর। সে কিমের একমাত্র সন্তান, যে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে এসেছে। গণমাধ্যম তাকে 'প্রিয় কন্যা' বলে ডাকে। ২০২২ সালের শেষ দিক থেকে তাকে বাবার সঙ্গে সামরিক কুচকাওয়াজ, অস্ত্র পরীক্ষা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা গেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্লেষকদের মতে, কিম তার মেয়েকে উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে তুলছেন। তবে তিনি যেকোনো সিদ্ধান্ত অনেক ভেবে-চিন্তে নেন। আবার অনেকে বলেছেন, চীন সফরে মেয়েকে সঙ্গে নেওয়া একটি বড় ধরনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে এত বড় আন্তর্জাতিক সমাবেশে, যেখানে বিশ্বের বড় বড় নেতারা উপস্থিত থাকবেন, সেখানে জুকে বিশ্বের সামনে পরিচিত করানোর বিশেষ কারণ আছে।

সিউল-ভিত্তিক ইউনিভার্সিটি অব নর্থ কোরিয়ান স্টাডিজের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াং মুজিন বলেন, সম্ভবত কিম মেয়েকে চীনের নেতৃত্বের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। কারণ চীন উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
সিউল-ভিত্তিক সেজং ইনস্টিটিউটের উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ চোং সিয়ং-চ্যাং বলেন, বেইজিং রেলওয়ে স্টেশনের দৃশ্য দেখে বোঝা গেছে—জু অ্যায়ে কেবল দেশে নয়, বিদেশেও তাকে উত্তর কোরিয়ার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তার ভাষ্য, 'তাকে চীনে নিয়ে কিম জং-উন বিশ্বকে স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছেন, তিনিই হবেন তার উত্তরসূরি।'
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিম জং-উনকে খুব কম বয়সে উত্তরসূরি হিসেবে মনোনীত করেছিলেন তার বাবা কিম জং-ইল। তবে ২০০৮ সালে তার বাবা স্ট্রোক করার আগ পর্যন্ত সে তথ্য গোপন রাখা হয়।
জু অ্যায়ে কে?
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, জু অ্যায়ে প্রথমবার বিশ্বে প্রকাশ্যে পরিচিত হন ২০২২ সালে। তখন তিনি বাবার সঙ্গে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণে যোগ দেন।
তবে প্রথমবার বিশ্বের সামনে কিমের মেয়ের অস্তিত্বের কথা প্রকাশ করেন সাবেক এনবিএ তারকা ডেনিস রডম্যান। ২০১৩ সালে পিয়ংইয়ং সফরে কিম তার সঙ্গে স্ত্রী রি সল-জু ও একটি কন্যাশিশুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, 'আমার মেয়ে'। পিয়ংইয়ংয়ের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম কখনো তার নাম উল্লেখ করেনি। তবে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দারা বলছেন, সে কিম ও তার স্ত্রী রি সল-জুর মেয়ে জু অ্যায়ে। তাদের ধারণা, কিম ও রি সল-জুর বিয়ে হয়েছিল ২০০৯ সালে।

জু অ্যায়ে কীভাবে প্রকাশ্যে এলো?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম তাকে 'প্রিয় কন্যা' বলে উল্লেখ করেছে। গণমাধ্যমের ছবিতে দেখা গেছে, উত্তর কোরিয়ার সিনিয়র কর্মকর্তারা তার সামনে হাঁটু গেড়ে সম্মান জানাচ্ছেন।
সর্বশেষ জনসমাগমগুলোতে দেখা গেছে, তিনি প্রায়ই তার ফুপু কিম ইয়ো-জং (শাসক দলের মুখপাত্র) ও মাকে পেছনে রেখে বাবার হাত ধরে সামনে হাঁটছেন। বাবার সঙ্গে কথা বলছেন কিংবা বাবার সঙ্গে বসে আছেন।
এমনকি দেখা গেছে, তিনি নিজের আগে মেয়েকে গাড়িতে উঠতে দিচ্ছেন।
জু অ্যায়ে তার বিলাসবহুল ফ্যাশনের জন্যও নজর কেড়েছে। তাকে গুচ্চি সানগ্লাস, কার্টিয়ের ঘড়ি পরতে দেখা গেছে। কখনো কখনো বাবার মতো একই রকম চামড়ার জ্যাকেট ও কালো চশমা পরে বাবার স্টাইল অনুকরণ করেছে।

এটা কি তার প্রথম বিদেশ সফর?
হ্যাঁ, বেইজিং সফরই কিমের সঙ্গে জু অ্যায়ের আনুষ্ঠানিক প্রথম বিদেশ সফর।
সিউলভিত্তিক ইউনিভার্সিটি অব নর্থ কোরিয়ান স্টাডিজের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াং মুজিন এএফপিকে বলেছেন, 'সে ধাপে ধাপে সামরিক ও কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছে। এর আগে, রুশ দূতাবাসের এক অনুষ্ঠানে তাকে দেখা যায়। কিন্তু এখন কিমের সঙ্গে একটি 'ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের' বিজয় দিবস উদযাপনে যোগ দিয়ে কার্যত বিদেশের মাটিতে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করল।'
ইয়াং যোগ করেন, দেশীয় মঞ্চ থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার আবির্ভাবকে বলা যায় 'উত্তরসূরি হওয়ার শেষ ধাপে' আছে।
কেন এই সফর গুরুত্বপূর্ণ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কিম পরিবারের কৌশলগত পদক্ষেপ। যেন জু অ্যায়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পান।
দক্ষিণ কোরিয়ার কিয়ংনাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ফার ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক লিম উল-চুল এএফপিকে বলেন, 'এটি কোনো সাধারণ পারিবারিক সফর নয়, কার্যত উত্তরসূরি হিসেবে তার অভিষেক।'
লিম আরও বলেন, 'আগের দৃষ্টান্তে দেখা গেছে, উত্তরাধিকারীরা চীন বা আন্তর্জাতিক সফরের মাধ্যমে তাদের অবস্থান শক্ত করে তোলেন। যেন সমাজতান্ত্রিক শক্তির কাছ থেকে বৈধতা পান।'
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কিম জং-উনের বাবা কিম জং-ইলকে তার বাবা কিম ইল-সুং উত্তরসূরি হিসেবে ১৯৮৩ সালে বেইজিং সফরে নিয়ে যান। সেই সফরে চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিংয়ের বাবা শি ঝোং-সুনের সঙ্গে তারা সাক্ষাৎ করেছিলেন।
লিম বলেন, 'জু অ্যায়ের ক্ষেত্রেও সেই ধারা মিলছে।'

জু অ্যায়ে কি সত্যিই কিমের উত্তরসূরি হতে পারবে?
২০২৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে যে, জু অ্যায়ে সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী উত্তরসূরি।
তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান চো তে-ইয়ং বলেন, 'জু অ্যায়ের প্রকাশ্য উপস্থিতি ও তাকে যেভাবে মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করে মনে হচ্ছে, সে সবচেয়ে সম্ভাব্য উত্তরসূরি।'
তবে জু অ্যায়ের এই স্বীকৃতির কথা মানতে নারাজ অনেক বিশ্লেষক। কারণ দক্ষিণ কোরিয়া সবসময় বলে এসেছে—উত্তর কোরিয়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তাই জু অ্যায়কে আগেই উত্তরসূরি ভাবা ঠিক হবে না।
কিন্তু সিউলভিত্তিক সেজং ইনস্টিটিউটের চোং সিয়ং-চ্যাং বলেন, অবশ্য তার সাম্প্রতিক কার্যক্রম ভিন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তিনি বলেন, 'এক সামরিক কুচকাওয়াজে জু অ্যায়ের সাদা ঘোড়া ছিল কিম জং-উনের ঘোড়ার পরেই দ্বিতীয় সারিতে। এটি তাকে উত্তরসূরি ভাবার বড় একটি প্রমাণ হতে পারে। উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যেই তাদের ছবি দিয়ে ডাকটিকিট ছেপেছে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসছে, এটিও বড় একটি প্রমাণ।'
জু অ্যায়ে কিমের কততম সন্তান
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশ কয়েক বছর ধরেই কিম জং উন ও তার স্ত্রী রি সোল-জুর তিন সন্তানের মধ্যে জু দ্বিতীয় বলে ধারণা করা হয়। তবে সঠিক সংখ্যা এবং তাদের ক্রম, কোনোভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কারণ কিম তার পরিবারের ব্যাপারে সবকিছু গোপন রাখতে পছন্দ করেন। তবে জু তাদের একমাত্র সন্তান, যার তথ্য দেশটির কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন। তার আর কোনো সন্তানকে এখনো প্রকাশ্যে দেখা যায়নি।
'রেসপেক্টেড' বিশেষণ
২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত জু অ্যায়ের সম্পর্কে খুব কমই তথ্য জানা যেত। তবে সে একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) উৎক্ষেপণে তার বাবার সাথে উপস্থিত হওয়ার পর আলোচনায় আসে। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে শীর্ষ কর্মকর্তাদের জন্য ভোজসভায় অংশ নেন। যেখানে জুকে 'রেসপেক্টেড' কন্যা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
বিবিসির তথ্যমতে, 'রেসপেক্টেড' বিশেষণটি উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত।

গোয়েন্দা তথ্য
দক্ষিণ কোরিয়ার ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (এনআইএস) প্রায় একই সময়ে জু অ্যায়ের বিষয়ে পার্লামেন্ট মেম্বারদের আরও কিছু তথ্য সরবরাহ করেছে বলে জানিয়েছে এপি।
তারা জানান, জু অ্যায়ে ঘোড়ায় চড়া, স্কিইং ও সাঁতার কাটতে পছন্দ করে। সে রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে বাড়িতে পড়ালেখা করে। ধারণা করা হচ্ছে, তার বয়স আনুমানিক ১২ বছর।
যাইহোক, কিন্তু মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো তাকে উত্তর কোরিয়ার বাইরে দেখা গেছে। তাই সে বাবার উত্তরসূরি হতে পারে, এমন জল্পনা আরও ডালপালা মেলেছে। তাই ধারণা করা হচ্ছে, পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কুসংস্কার দূর করার চেষ্টায় কিম এই মুহূর্তে তার মেয়েকে সামনে এনেছেন। কারণ দেশটির নেতৃত্বে কখনো কোনো নারী ছিলেন না।
এখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা দরকার, ১৯৪৮ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া শাসন করে আসা কিম পরিবার দেশটির নাগরিকদের বলেছে, তারা পবিত্র বংশ থেকে এসেছে, যার অর্থ কেবল তারাই দেশকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
Comments