যেভাবে উত্তর কোরিয়ায় ব্যর্থ হয় ‘সিল টিম ৬’-এর গোপন মার্কিন অভিযান

২০১৯ সালের এক শীতের রাত। মার্কিন নৌবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো দল 'নেভি সিল ৬'-এর সদস্যরা উত্তর কোরিয়ার উপকূলে এক অতি গোপন অভিযানে নামেন। উদ্দেশ্য ছিল দেশটির সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-উনের ফোনালাপ শোনার জন্য একটি গোয়েন্দা যন্ত্র স্থাপন করা। কিন্তু নিখুঁত পরিকল্পনা থাকলেও সেই অভিযান ব্যর্থ হয়।
এই অভিযান এতটাই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল যে এর জন্য সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুমোদন নিতে হয়েছিল। ধরা পড়লে ভিয়েতনামে কিম জং উনের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা ভেস্তে যেতে পারত। এমনকি ধরা পড়লে মার্কিন সেনারা জিম্মিও হতে পারতেন।
ঘটনার ছয় বছর পর নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে সেই লোমহর্ষক অভিযানের কথা উঠে এসেছে। বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্যের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে উত্তর কোরিয়া বরাবরই এক দুর্ভেদ্য দেয়ালের মতো। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন কিম জং-উনের সঙ্গে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনায় বসেন, তখন কিমের মনোভাব বোঝা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। এ জন্য কিমের কথোপকথন রেকর্ড করতে উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। এই কঠিন দায়িত্বটি দেওয়া হয় 'সিল টিম সিক্স'-এর 'রেড স্কোয়াড্রন'-কে, যারা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার অভিযানে অংশ নিয়েছিল।
পরিকল্পনা ছিল। একটি পারমাণবিক সাবমেরিন উত্তর কোরিয়ার জলসীমার কাছে যাবে। সেখান থেকে দুটি ছোট 'মিনি-সাবমেরিন'-এ চড়ে নেভি সিলের একটি দল উপকূলে পৌঁছাবে। উত্তর কোরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে যন্ত্রটি স্থাপন করে আবার ফিরে আসবেন তারা।
অভিযানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল উত্তর কোরিয়ার ভেতরের তথ্যের অভাব। এ ধরনের অভিযানে সাধারণত ড্রোন বা অন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরাসরি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তা সম্ভব ছিল না। ভরসা ছিল কেবল কয়েক মিনিট পরপর আসা স্যাটেলাইটের ছবি। অর্থাৎ, উপকূলে কোনো বিপদ অপেক্ষা করলে সিল সদস্যদের তা আগে থেকে জানার উপায় ছিল না।

যেভাবে ব্যর্থ হলো অভিযান
কয়েক মাসের কঠোর অনুশীলনের পর ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলটি রওনা দেয়। ভিয়েতনামে ট্রাম্প ও কিমের বৈঠকের ঠিক আগমুহূর্তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অভিযানের চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।
পারমাণবিক সাবমেরিন থেকে দুটি মিনি-সাবমেরিনে চেপে বসেন কমান্ডোরা। মিনি সাবমেরিন দুটি তখন উপকূল থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, শীতের রাতে এলাকাটি জনশূন্য থাকার কথা ছিল। কিন্তু সেখানেই ঘটে প্রথম ভুল। দুটি মিনি-সাবমেরিন সমুদ্রের তলদেশে পার্ক করার সময় একটি সাবমেরিন উপকূলের একটু বেশি-ই কাছে চলে যায়। সেটি ঘুরিয়ে এনে অন্য মিনি সাবমেরিনটির সঙ্গে পার্ক করা হয়। এতে কিছুটা সময় নষ্ট হয় এবং সাবমেরিন দুটি ভিন্ন দিকে মুখ করে থাকে।
এরপর আটজনের কমান্ডো দল উপকূলে নেমে তাদের ডাইভিং সরঞ্জাম খুলতে শুরু করে। তারা তখনো জানত না যে অন্ধকার সাগরে একটি ছোট মাছ ধরার নৌকা ভাসছে। আর জেলেরা শীতের রাতে ঠান্ডা পানিতে রাবারের স্যুট পরে থাকায় নাইট-ভিশন গগলসের থার্মাল সেন্সর দিয়ে তাদের দেখাও যায়নি।
একই সময়ে, মিনি-সাবমেরিনের পাইলটরা যখন একটি সাবমেরিনকে ঘোরাতে যান, তখন মোটরের শব্দে বা খোলা ককপিটের আলোতে নৌকার আরোহীদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। নৌকাটি মিনি-সাবমেরিনের দিকে এগোতে শুরু করে এবং জেলেরা টর্চলাইট দিয়ে পানিতে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এ কারণে উপকূলে থাকা সিল সদস্যরা বুঝতে পারছিলেন না, এটি জেলেদের নৌকা নাকি নিরাপত্তা টহল। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় দূরে থাকা কমান্ডার বা মিনি-সাবমেরিনের দলের সঙ্গে পরামর্শ করারও কোনো উপায় ছিল না।
পরিস্থিতি আরও জটিল হয় যখন নৌকা থেকে একজন ব্যক্তি পানিতে ঝাঁপ দেন। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে উপকূলে থাকা দলের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। বাকিরাও তাকে অনুসরণ করেন। মুহূর্তের মধ্যে নৌকার আরোহী দুই-তিন জন নিহত হন।
গুলি চালানোর সঙ্গে সঙ্গেই সিল সদস্যরা বুঝতে পারেন যে অভিযান ব্যর্থ হয়ে গেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তাদের তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে সরে যেতে হতো। দলটি নৌকার কাছে গিয়ে নিশ্চিত হয় যে নিহতরা বেসামরিক নাগরিক। সম্ভবত তারা শামুক শিকার করছিল। তাদের কাছে কোনো অস্ত্র বা সামরিক পোশাক ছিল না।
কর্তৃপক্ষের চোখ এড়াতে সিল সদস্যরা মৃতদেহগুলোকে পানিতে ডুবিয়ে দেয়। এরপর তারা বিপদ সংকেত পাঠালে মূল পারমাণবিক সাবমেরিনটি ঝুঁকি নিয়ে উপকূলের কাছাকাছি এসে তাদের তুলে নেয় এবং দ্রুত আন্তর্জাতিক জলসীমার দিকে পালিয়ে যায়।
এই ঘটনার পরপরই মার্কিন গোয়েন্দা স্যাটেলাইট ওই অঞ্চলে উত্তর কোরীয় সেনাবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির বিষয়টি শনাক্ত করে। তবে পিয়ংইয়ং প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি। তারা আসলেই জানতে পেরেছিল কি না যে এর পেছনে কারা ছিল, তা আজও স্পষ্ট নয়।
এর কিছুদিন পরেই ভিয়েতনামে ট্রাম্প-কিমের বৈঠক কোনো চুক্তি ছাড়াই শেষ হয়। কয়েক মাসের মধ্যে উত্তর কোরিয়া আবার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা শুরু করে এবং তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি আগের চেয়েও গতিশীল হয়। উত্তর কোরিয়ার কাছে এখন আনুমানিক ৫০টি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
Comments