শিশুর মানসিক বিকাশে কোকোমেলনের প্রভাব ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক
কিউট চরিত্র, বর্ণিল রঙের ছড়াছড়ি এবং সঙ্গে মনকাড়া মিউজিক- এই সবকিছু মিলে তৈরি হয়েছে ইউটিউব চ্যানেল কোকোমেলন। মা-বাবা হোক বা শিশু, কেউই এটির আবেদন সহজে উপেক্ষা করতে পারেন না।
ঢাকা শহরে যেসব বাবা-মা চাকরি, পরিবার সবকিছুর মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলতে চান তাদের জন্য বর্তমানে এটি যেন জীবনরক্ষাকারী হয়ে এসেছে। এটি আমাদের কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে, কাজ শেষ করতে অথবা কাজের শেষে কিছুটা বিরতি নিতে সাহায্য করছে। তবে কিছু অভিভাবক তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্ন তুলছেন, কোকোমেলন কি আসলে বাচ্চাদের সাহায্য করার বদলে তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে?
ব্যবসায়ী রাজীব বলেন, শুরুতে কোকোমেলনকে তার আশীর্বাদ মনে হতো।
তিনি তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, 'শুরুতে এটি ছিল একেবারে পারফেক্ট! আমার বাচ্চা চুপচাপ বসে মনোযোগ দিয়ে কোকোমেলন দেখত আর আমি নিশ্চিন্তে আমার ফোন কলগুলো রিসিভ করতাম।'
তারপর ধীরে ধীরে রাজীব কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করতে শুরু করেন।
'সে সারাক্ষণ কোকোমেলন দেখতে চাইতো শুধু তাই না, আমরা যখনি সেটা বন্ধ করে দিতে চাইতাম সে ভয়ংকর জেদ করত। তারপর আমার মনে হল আমরা এর নিয়ন্ত্রণই হারিয়ে ফেলছি।'
বিশেষজ্ঞ সাইকোথেরাপিস্ট আবদুল হামিদ বলেন, 'প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও আমরা ক্রমাগত স্ক্রলিং আর হাজারো কনটেন্টের ভিড়ে অনলাইন দুনিয়াতে আসক্ত হয়ে পড়ি। চারপাশের সবার মতো আমরা অনলাইন দুনিয়াতেই আমাদের সব এনার্জি খরচ করে ফেলছি।'
তিনি আরো বলেন, 'মনে করুন একটি বাচ্চার সারাদিনের একমাত্র বিনোদন বা কাজ হল কোকোমেলন দেখা। বাচ্চারা সারাক্ষণ এরকম একমুখী ডিভাইসে আসক্ত থাকলে স্বাভাবিকভাবে তারা নিজের ইন্দ্রিয়গুলো ব্যবহার করতে চায় না। তারা কোনোকিছু জানতে চাওয়া বা অনুসন্ধানের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, যা তাদের বয়সের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।'
অতিরিক্ত উদ্দীপনার জগৎ
শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণ করে দীর্ঘ সময় তা ধরে রাখার জন্যই কোকোমেলনের ভিডিওগুলোতে দেখা যায় দ্রুত দৃশ্য পরিবর্তন, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার এবং অনবরত চলতে থাকা মিউজিক। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, একটি বাচ্চার বেড়ে ওঠার পেছনে ক্রমাগত এত রকম তথ্য নেওয়ার বাধা উল্টো তার মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। নবজাতকরা তাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সবকিছু অনুধাবন করার চেষ্টা করে। কিন্তু যখন সে চারপাশ থেকে এতরকম উদ্দীপনা পায় তখন তার নিজস্ব অনুভূতি নিয়ে সে ভাবতে পারে না।
স্কুলশিক্ষক এবং দুই বাচ্চার মা সোমাইলা নিজে এরকম ঘটনার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন।
তিনি বলেন, 'কয়েক এপিসোড দেখার পরেই আমার বাচ্চা কোথায় যেন হারিয়ে যেত। আমি ডাকলে সাড়া দিত না, এবং যদি আমরা টিভি বন্ধ করে দিতাম তাহলে তার মন খারাপ হয়ে যেত।'
সোমাইলার মতো অভিভাবকদের জন্য এই ব্যাপারটির পরিণাম সামলানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, 'আমি এর মাধ্যমে আমার বাচ্চাকে কিছুটা বিনোদন ও বিরতি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এটি বন্ধ হয়ে গেলেই আমার বাচ্চা খিটিখিটে আচরণ ও বিরক্তি প্রকাশ করে।'
শিশুর স্পিচ ডিলে বা দেরিতে কথা বলা
কোকোমেলনের সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি সমস্যা মনে করা হয় শিশুর দেরিতে কথা বলাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ধরনের অনুষ্ঠান শিশুকে পরোক্ষভাবে ব্যস্ত রাখে এবং তারা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে না। মানুষের সঙ্গে কথা বলার পরিবর্তে তারা সবসময় সেই স্ক্রিনের শব্দ ও দৃশ্যের প্রতি মনোযোগী থাকে।
দুই সন্তানের মা অর্থি বলেন, 'আমি শুরুতে এটি খেয়াল করিনি। আমার ছোট বাচ্চা প্রায় প্রতিদিন কোকোমেলন দেখতো। তখন আমি মনে করলাম সম্ভবত এজন্যই তার কথা বলতে দেরি হচ্ছে। আসলেই এটি বন্ধ করার পর সে দ্রুত কথা বলা শিখে যায়। সহজ শব্দ যেমন ''মামা'', ''দাদা'' বলা শুরু করেছিল যা এর আগে সে কখনোই বলেনি।'
স্ক্রিন টাইম কমানোর পর অনেক অভিভাবকই বাচ্চার কথা বলায় বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন।
নির্ভরতা এবং রাগ-জেদ
কোকোমেলনের বর্ণিল দুনিয়া আর মজাদার সব কনটেন্ট দেখার পর সত্যিকারের পৃথিবীকে নিরস লাগতে পারে। কোকোমেলনের অনুষ্ঠানগুলোর দৃশ্য খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হতে থাকে। তাই দৈনন্দিন জীবনকে খুব ধীরগতির মনে হয় বাচ্চাদের। এটি ধীরে ধীরে শিশুদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রচণ্ড জেদ শুরু করে।
এ বিষয়ে চাকরিজীবী শাহরিয়ার বলেন, 'শুরুর দিকে কোকোমেলন ছিল চমৎকার। এটি আমার ছেলেকেও যেমন খুশি রাখতো তেমনি আমাকে কাজের পর একটু বিশ্রাম নিতে সাহায্য করত। কিন্তু এরপর এটি ঝামেলায় পরিণত হল। এটি ছাড়া সে চিৎকার করতো এবং খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিত। কোনোকিছুই তাকে শান্ত করতে পারত না।'
অন্যান্য অভিভাবকও একই রকম অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন, যাদের বাচ্চার কোকোমেলন দেখা একরকম নেশা হয়ে গিয়েছিল।
শাহরিয়ার আরও বলেন, 'একটা ব্যস্ত দিনের পর এই একটি জিনিস তাকে শান্ত করতে পারত। কিন্তু আমরা জানতাম এটি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে তার জেদ শুরু হয়ে যাবে। এই জিনিসটির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে উঠছিল সে।'
অভিভাবকের করণীয়
শিশুর বিনোদনের জন্য কোকোমেলন ব্যবহার করলেও তা সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। রাজীব ধীরে ধীরে স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেছিলেন।
তিনি বলেন, 'আমরা এখন এটি নিয়ন্ত্রণ করি। আমি আমার বাচ্চাকে দিনে একটি এপিসোড দেখতে দিই। পাশাপাশি বই, পাজল দিয়ে ও তার সঙ্গে খেলাধুলার মাধ্যমে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। এই পরিবর্তন আনা কিছুটা কঠিন হলেও এটি ভীষণ উপকারী ছিল।'
স্ক্রিন টাইম নিয়ন্ত্রণ করুন
প্রতিদিন কোনো অনুষ্ঠানের একটি বা দুইটি এপিসোড দেখুন। এটি অতিরিক্ত উদ্দীপনা কমিয়ে ভারসাম্য রাখতে সহায়তা করবে।
ধীরগতির কনটেন্ট বেছে নিন
ব্লুয়ি বা ড্যানিয়েল টাইগারের মত হালকা ধরনের অনুষ্ঠান বাচ্চাদের বিনোদনের খুব ভালো উৎস হতে পারে। এরকম অনুষ্ঠান তাদের বিনোদনকে অর্থবহ করে তুলে।
বিভিন্ন খেলায় উৎসাহ দিন
সবসময় এ ধরনের বিনোদনের ওপর নির্ভর না করে বিভিন্ন ধরনের খেলায় উৎসাহী করে তুলুন। ঢাকার মতো শহর এলাকায় বাচ্চাকে গল্প বলা, ছবি আঁকা বা শিশুদের উপযোগী ক্লে দিয়ে খেলার সুযোগ করে দিতে হবে।
একসঙ্গে দেখুন
সবাই একসঙ্গে কোনো কিছু দেখলে সেটি চমৎকার একটি অভিজ্ঞতায় রূপান্তর হয়। স্ক্রিনে কী ঘটছে তা নিয়ে আপনার বাচ্চার সঙ্গে কথা বলুন, তাকে প্রশ্ন করুন এবং তাদের উত্তর দেওয়ার সুযোগ করে দিন।
অর্থির জন্য পরিবর্তনটা ছিল রাত দিনের মতো।
'সারাদিন কোকোমেলন চলার বদলে এখন আমরা বই পড়ি এবং আমার বাচ্চা আমার সঙ্গে কথা বলে। এই পরিবর্তনটা আনার আগে আমি বুঝতেই পারিনি এটি কীভাবে আমার বাচ্চাকে প্রভাবিত করছিল।'
আধুনিক যুগের নিজেদের ব্যস্ত সময় আর পরিবার সামলানোর চাপে কোকোমেলন বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার সহজ সমাধান। তবে ঢাকাসহ সব জায়গার অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখা উচিত বাচ্চাকে কতটুকু স্ক্রিন টাইম দেয়া হচ্ছে এবং তার বিকাশে এটি কী রকম ভূমিকা রাখবে। স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দেওয়া, খুব দ্রুতগতির অনুষ্ঠান না দেখা এরকম ছোট ছোট পরিবর্তনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে শিশুর বিকাশে যেন কোনো বাধা না আসে। কেউই চায় না কোনো টিভি অনুষ্ঠান তার বাচ্চার আওয়াজ কেড়ে নিক।
অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম
Comments