শিশুর পড়ায় মনোযোগ নেই, কী করবেন

শিশু পড়তে চায় না
ছবি: সংগৃহীত

শিশু একদমই পড়তে চায় না, পড়ায় কোনো মনোযোগ নেই-এ নিয়ে চিন্তায় ভোগেন অনেক বাবা-মা। এই পড়তে না চাওয়ার কারণ ও এর সমাধান সম্পর্কে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা আহমেদ।

শিশুর পড়ায় মনোযোগ না থাকার কারণ

ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, শিশুদের পড়ায় অনাগ্রহের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে পরিবেশগত কারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১.বর্তমানে শিশুদের পড়ায় মনোযোগ না থাকার পেছনে ডিজিটাল ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহার বা স্ক্রিন টাইম বেশি হওয়া একটি অন্যতম কারণ। শিশুদের স্ক্রিন টাইম বেশি দেওয়া হলে আচরণগত সমস্যা হয় ও অমনোযোগ দেখা দেয়। শিশুদের স্কুলে দেওয়ার আগে, প্রাথমিক শৈশব বিকাশের সময় যখন মস্তিষ্ক বিকশিত হয়, ওই বয়সে বেশি বেশি ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে যেসব শিশু, পরে পড়ালেখা করতে গেলে তাদের ভেতর আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। টেলিভিশন, মোবাইল, ভিডি গেম কিংবা রিলস দেখা অর্থাৎ অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুদের পড়াশোনায় অমনোযোগী করে তোলে।

২. পড়াশোনার প্রতি প্যারেন্টিং স্ট্রেস বা বাবা মায়ের অতিরিক্ত চাপ এবং খেলাধুলার সুযোগের অভাবে শিশু পড়ায় অমনোযোগী হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় সে স্কুলে যাচ্ছে, কোচিং যাচ্ছে, বাসায় শিক্ষক আসছেন পড়াতে, সবসময় অতিরিক্ত চাপের কারণে শিশুরা পড়ায় ঠিকভাবে মনোযোগ দিতে পারে না।

৩. পড়ায় অমনোযোগীতার পেছনে ঘুমের ব্যাঘাত একটি অন্যতম কারণ। বয়স অনুযায়ী যদি ঘুম অপর্যাপ্ত হয়, নিয়মিত রাত জাগে তাহলে শিশুর পড়ালেখায় মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটতে পারে।

৪. স্লিপ অ্যাপনিয়া শিশুর পড়ায় মনোযোগহীনতার একটি অন্যতম কারণ। কোনো কারণে যদি শিশুর এডিনয়েড গ্রন্থি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে যায় তাহলে স্লিপ অ্যাপনিয়া হতে পারে। এতে শিশু কিছুক্ষণ পর পর ঘুম থেকে উঠে যাবে, ঠিকমতো ঘুমাতে পারবে না। এডিনয়েড বড় হলেও পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে।

৫. শিশুর যদি রক্তস্বল্পতা থাকে, আয়রনের ঘাটতি থাকে তাহলে পড়ায় মনোযোগ কমে যেতে পারে।

৬. কোনো শিশুর যদি লো ভিশন থাকে বা চোখে কম দেখে, দৃষ্টিশক্তির বিকাশ ঠিকমত না হয় সেসব শিশুদের পড়ালেখায় মনোযোগ কম থাকে।

৭.  অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার (এডিএইচডি) শিশুদের অতি চঞ্চলতা ও অমনোযোগীতা থাকে। এটি শিশুর বিকাশজনিত একটি সমস্যা যা জেনেটিক এবং পরিবেশগত কারণে হতে পারে। শিশুর পড়ালেখায় মনোযোগ না থাকার পেছনে এটি একটি অন্যতম কারণ।

৮. বয়সের তুলনায় বুদ্ধি কম থাকাও একটি অন্যতম কারণ। বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা জেনেটিক কারণে হতে পারে, হরমোনের ঘাটতি, শিশুর জন্মের পর দেরি করে কাঁদা বা অক্সিজেনের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। বুদ্ধি প্রতিবন্ধকতা থাকলে শিশুর পড়ায় অমনোযোগ থাকে।

৯. কিছু কিছু মৃগী রোগ বিরল হলেও কিছু এপিলেপসি আছে যা বাইরে থেকে খিঁচুনি দেখা যায় না কিন্তু শিশুর বুদ্ধি কমতে থাকে, পড়ায় অমনোযোগ থাকে এবং আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়।

করণীয় এবং সচেতনতা

ডা. সানজিদা আহমেদ বলেন, শিশুর বিকাশ ও মনোযোগী হওয়ার পেছনে ইতিবাচক প্যারেন্টিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চাকে খুব গুরুত্ব দিতে হবে, বাচ্চার সঙ্গে গুণগত সময় কাটাতে হবে, সবকিছুর জন্য প্রশংসা করতে হবে, অল্প পারলেও অনেক বেশি প্রশংসা করে আত্মবিশ্বাস ঠিক রাখতে হবে। শিশুর স্ক্রিন টাইম কমিয়ে দিতে হবে, ডিজিটাল ডিভাইস দেওয়া যাবে না। হাতে মোবাইল না দিয়ে দৈনন্দিন কাজে সন্তানকে যুক্ত করতে হবে। এর ফলে শিশুর বিকাশ ভালো হয়। পড়ালেখার জন্য ভালো পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।  খেলাধুলা করার সময় দিতে হবে, সময়মতো ঘুমানোর অভ্যাস করতে হবে। এ ছাড়া নেতিবাচক প্যারেন্টিং করা যাবে না, পড়ালেখা না পারলেও শিশুকে নেতিবাচক মন্তব্য করা যাবে না।

শিশু পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না, সেক্ষেত্রে বাবা-মাকে কিছু বিষয়ে খেয়াল করতে হবে, সন্তানকে নিয়ে সচেতন হতে হবে। যেমন-

১. সন্তানের আচরণগত সমস্যা আছে কি না, অতি চঞ্চল কি না, যে সব ভেঙেচুরে ফেলছে, সবাইকে মারছে, সারাক্ষণ দৌড়াদৌড়ি করছে এমন অস্থিরতা আছে কি না তা খেয়াল করতে হবে।

২. বয়স অনুযায়ী সে পড়ালেখায় অমনোযোগী কিন্তু বয়স অনুযায়ী বুদ্ধি আছে কি না, কথাবার্তা গুছিয়ে বলতে পারে কি না এসব ব্যাপারে খেয়াল করতে হবে।

৩. শিশুর ঘুমের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ঘুমের সময় নাক ডাকছে কি না, ঘুম বার বার ভেঙে যাচ্ছে কি না, ঘুমানোর সময় মুখ খোলা থাকে কি না পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

৪. শিশু যদি খুব সামনে বসে টেলিভিশন দেখে, বই অনেক কাছে এনে পড়ে তখন বুঝতে হবে শিশুর চোখেও সমস্যা থাকতে পারে। শিশুর ৩ থেকে ৫ বছর বয়সে একবার চোখের দৃষ্টি পরীক্ষা করানো দরকার।

৫. শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঠিক আছে কিনা তা খেয়াল করে দেখা বাবা-মায়ের কর্তব্য। শিশুর বিকাশ ঠিকমত না হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। অনেক বাবা-মা শিশুর পড়ায় মনোযোগ না থাকলে, ঠিকমত পড়ালেখা না করলে তাকে মারধর করেন, অতিরিক্ত চাপ দেন যা ঠিক নয়। পড়ায় মনোযোগ না থাকার পেছনে যে অনেকগুলো কারণ আছে সেগুলো বের করতে হবে, জানতে হবে। এজন্য বাবা-মায়ের সচেতনতা খুব জরুরি। কারণগুলো শনাক্ত করে যদি সময়মতো শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া যায় তাহলে সমস্যা অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব এবং শিশু পিছিয়ে পড়বে না।

চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ইতিহাস নিয়ে, প্রয়োজন অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। শিশুর শরীরে হরমোন ও আয়রনের ঘাটতি আছে কি না, বয়স অনুযায়ী বুদ্ধি ঠিক আছে কি না, এডিএইচডি আছে কি না, এডিনয়েড গ্রন্থি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়েছে কি না, বিরল হলেও কোনো মৃগী রোগ আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। সমস্যা শনাক্ত করে চিকিৎসা দিলে বয়স অনুযায়ী শিশু বিকাশ লাভ করতে পারবে এবং পড়ালেখায় মনোযোগী হতে পারবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh Police: Designed to inflict high casualties

A closer look at police’s arms procurement records reveals the brutal truth behind the July killings; the force bought 7 times more lethal weapons than non-lethal ones in 2021-23

7h ago