শতবর্ষ পেরিয়েও চায়ে-আড্ডায় জমজমাট বোস কেবিন
নারায়ণগঞ্জ সদরের দিগু বাবুর বাজারের কাছে অবস্থিত বোস কেবিন। শহরের ১ ও ২ নম্বর রেলগেটের মাঝে ফলপট্টিতে এর অবস্থান। নীলচে রঙের দেয়ালে সাদা রঙে লেখা এই নামটির সঙ্গে মিশে আছে অনেকের অনেক সুখস্মৃতি।
সময়টা ১৯২১ সাল। বিক্রমপুরের (আজকের মুন্সিগঞ্জ) শ্রীনগরে ছিল নৃপেন বোসের বাড়ি। ২০ বছরের যুবক তখন নৃপেন। ডাকনাম ভুলু দিয়েই লোকের কাছে পরিচিত ছিলেন তিনি।
এন্ট্রাস পাশ করে চাকরির চেষ্টা করলেন না। সাফ কথা, করবেন না ব্রিটিশদের চাকরি। বাড়ি ছেড়ে ঢাকা এলেন। নারায়ণগঞ্জ তখন ঢাকা জেলারই অংশ। ভুলু বাবুর কাকা ছিলেন এখানকার জেলার। নারায়ণগঞ্জের আজকের উপজেলা বন্দর তখন খুব জমজমাট। কলকাতার সঙ্গে ছিল সরাসরি যোগাযোগ। শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে উঠা এই মহকুমা ভালো লেগে গেল নৃপেন চন্দ্র বোসের।
সে সময়ে রেল স্টেশনের পাশেই ছিল ব্যানার্জি কেবিন। ছোট টং ঘরের মতো আকার। লাভের মুখ দেখতে না পারায় সেটি বিক্রি করে দেওয়া হয়। কেবিনটির দায়িত্ব নেন নৃপেন। ছোট দোকানে তখন শুধু ২ ধরনের চা ও লাঠি বিস্কুট মিলত। দার্জিলিং ও আসামের চায়ের মিশ্রণে কড়া লিকারের চা তৈরি করতেন নৃপেন বোস।
সে বড় উত্তাল সময়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া তরুণদের সম্মেলনের স্থানে পরিণত হয় বোস কেবিন। চা ব্যবসার পাশাপাশি বিপ্লবীদের চিঠি চালাচালির কাজেও সহায়তা করতে থাকেন নৃপেন বোস।
অনেকে ধারণা করেন, বোস কেবিনের নামটি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নাম থেকে নেওয়া। তবে তা সত্য নয়। ব্যানার্জি কেবিন বোস কেবিন হয়েছিল নৃপেন বোস তথা ভুলু বাবুর পদবি থেকেই।
তবে সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তার। গত শতকের ত্রিশের দশকে ঢাকা আসার পথে নারায়ণগঞ্জে নেতাজিকে আটকায় পুলিশ। তখন ২ জগ চা বানিয়ে নেতাজির জন্য নিয়ে যান নৃপেন। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি।
নৃপেন বোস বেঁচে ছিলেন ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। তার জীবদ্দশায় মেজোপুত্র রবীন্দ্র চন্দ্র বোস ও তারপর নাতি তারক বোস এর হাল ধরেন। শুরুতে ১ নম্বর রেলগেট ও স্টিমার ঘাটের কাছে ছিল দোকানটি। ১৯৮৮ সালে এটি স্থানান্তরিত হয় ২ নম্বর রেলগেটের কাছে, চেম্বার রোডে। নামের সঙ্গে নিউ যুক্ত হয়ে এটি হয় নিউ বোস কেবিন।
তারক বোস বর্তমানে অবস্থান করছেন ভারতে। বছর দশেক আগে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন স্ত্রী-সন্তানকে। স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য গত ৫ মাস তিনি আছেন কলকাতাতেই। এর ভেতর রটনা হয়ে গেছে, বোস কেবিন নাকি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে! স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী নাকি কিনে নিচ্ছেন সেটি।
তবে বর্তমানে দোকান চালানো সুদীপ সাহা ব্যাপারটি সত্য নয় বলে জানান। তিনি দোকানের ম্যানেজার। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দোকানের তদারকিতে ব্যস্ত থাকেন।
তিনি বলেন, 'তারক বাবুর স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তিনি গত ৪-৫ মাস দেশে নেই। কিন্তু দোকান বিক্রি করে দিচ্ছেন, এমন কিছু আমাদের জানাননি। তাছাড়া, তার মা প্রায়ই আসেন, টাকা বুঝে নেন। দোকান বিক্রি হবে বা হতে যাচ্ছে এটা এখন পর্যন্ত গুজব। এ বিষয়ে মালিক আমাদের কিছু জানাননি।'
দোকানটিতে পা পড়েছে মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক রাজনীতিবিদের। এসেছেন শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণদের মতো কবি-সাহিত্যিকরাও।
জমজমাট আড্ডার এই স্থানে শুরুতে শুধুই চা বিক্রি হলেও পরে পরোটা-ডাল-ডিম যুক্ত হয়। গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে এখানে দুপুর বেলায় পোলাও, মুরগি ও খাসি রান্নাও শুরু হয়। বিকেলের পর থেকে পাওয়া যায় কাটলেট, চপ। দুপুরের ২ ঘণ্টা (১২টা-২টা) বাদে বাকি সময় পাওয়া যায় চা। শুরুতে কড়া লিকারের চা থাকলেও পরে চালু হয় দুধ চাও।
বোস কেবিনের খাবার আইটেমগুলো মূলত উপলক্ষ। এর আসল আবেদন আড্ডায়। নানা মতের লোকজন চা, চাপ, ওমলেট, কাটলেট খেতে আসেন এখানে। সবাই মিলে হয় প্রাণবন্ত আড্ডা। নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মীদেরও খুব প্রিয় জায়গা বোস কেবিন।
বয়স শতক পেরোলেও বোস কেবিন মানের দিক থেকে আপস করে না বলে জানান সুদীপ। এক সময় এখানকার সন্দেশ ছিল বিখ্যাত, তবে ভালো মানের দুধ না পাওয়ায় সন্দেশ এখন আর বানান না তারা। চা বিক্রি এখনো বেশ হয়। চায়ের কারিগর মতি বোস আছেন প্রায় ৩২ বছর হলো। তাকে গত এক দশক ধরে সহায়তা করেন সৌম্যনাথ বণিক।
তিনি বলেন, 'শুনেছি ৮০-৯০ দশকে দিনে ২০-২৫ কেজি চা পাতার চা হতো। এখনো হয়, ৭-৮ কেজি চা পাতার চা। আগের চেয়ে চা কম খায় লোকজন, তবে খুব কম না।'
বোস কেবিনে ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে আসেন আজিজুল ইসলাম। তিনি আসেন মূলত আড্ডা দিতেই।
তার ভাষ্য, 'এখানকার সকালের স্পেশাল ওমলেটটা ভালো। দুপুরের পোলাও-মাংসও। এক সময় পোলাও রান্না হলে আশপাশটা ঘ্রাণে ভরে উঠত। এখনো স্বাদ ভালোই আছে। বিকেলের পর বিক্রি হয় কাটলেট, চপ, চা। কাটলেটটা চমৎকার, কড়া লিকারের চায়ের সঙ্গে ভালো মানিয়ে যায়। আর আমাদের আড্ডা তো আছেই।'
শতবর্ষ পেরোনো বোস কেবিন এখনও প্রাণবন্ত ও কোলাহল মুখরিত। প্রথম কেবিনের ভেতরে আছে আরেকটি কেবিন। ২টাতেই ২০-২৪ জন বসতে পারেন। অনেককেই দেখা যায়, এসে দাঁড়িয়ে আছেন। বসার জন্য আসন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
সুদীপ সাহা বলেন, 'দোকান এখনও খুব জমজমাট। তারক বাবু না থাকলেও ফোনে নিয়মিত খোঁজ নেন, দিকনির্দেশনা দেন। সব ভালোই চলছে। আর দোকান বিক্রি নিয়ে তিনি স্পষ্ট কিছু না বলা পর্যন্ত এটা রটনা বা গুজব হিসেবেই ধরে নিতে পারেন।'
Comments