যেভাবে এক কাপ কফিতে আশ্রয় খুঁজে পাই

জার্মানির শীতে যখন বারবার মাকে জড়িয়ে ধরিয়ে পাওয়া ওমের কথা মনে পড়ে, তখন বিদেশের মাটিতে সবসময় আমার সঙ্গে রাখা ‘ছোট্ট এক টুকরো দেশের’ মাঝে সেই উষ্ণতাটা খুঁজে নিই। এই এক টুকরো দেশ হলো নর্থ এন্ডের এক কাপ কফি।
ছবি: মালিহা ফাইরুজ

সাওদাদ (Saudade) শব্দটা পর্তুগিজ। বাংলায় একে এক শব্দে প্রকাশ করা বেশ কঠিন। ধরে নেওয়া যেতে পারে, কোনো কিছু বা কারো জন্য এক অপার নিঃসঙ্গ প্রতীক্ষা হচ্ছে সাওদাদ। পর্তুগিজ স্কলার অব্রে বেল তার ১৯১২ সালে প্রকাশিত বই 'ইন পর্তুগালে' সাওদাদ শব্দটিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন ' এটি এমন একটা কিছুর প্রতি অস্পষ্ট ও নিরন্তর আকাঙ্ক্ষা, যার সম্ভবত কোনো অস্তিত্বই নেই'! কল্পনায় যখন একটা আপন ঘরের কথা চিন্তা করতে যাই, তখনই তীব্রভাবে এই সাওদাদ অনুভব করি। আমার ঈর্ষা হয় তাদের প্রতি, যাদের ঘর বলে একটা জায়গা আছে। এক শক্ত ভরসার জায়গা আছে, যেখানে গেঁথে আছে তার পরিচয় আর সত্ত্বা।

আমার এমন ঘর আমার কৈশোরের ও তারুণ্যের প্রথম দিকের স্মৃতিময় ঢাকায়। শীতের রাতে নর্থ এন্ডে এক কাপ গরম কফি নিয়ে বসে থাকায়, বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা-তাস-লুডুর মাঝে কিংবা পুরান ঢাকায় আমাদের বাড়ির লিভিংরুমে কাজিনদের সঙ্গে গল্প করে কাটানো সব অবসর মুহূর্তগুলোয়।

ছোট ছোট সব মুহূর্ত, রিকশায় করে পছন্দের মানুষটার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, নর্থ এন্ড ক্যাফেতে একটা ছোট্ট ডেট। সেসব উষ্ণতায় মোড়ানো স্মৃতির মুহূর্তগুলো ফিরে পেতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি তো জানি, এখন প্রিয়জনদের থেকে অনেক দূরে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে সেই উষ্ণতা আমি আর চাইলেই খুঁজে পাব না।

জার্মানির শীতে যখন বারবার মাকে জড়িয়ে ধরিয়ে পাওয়া ওমের কথা মনে পড়ে, তখন বিদেশের মাটিতে সবসময় আমার সঙ্গে রাখা 'ছোট্ট এক টুকরো দেশের' মাঝে সেই উষ্ণতাটা খুঁজে নিই। এই এক টুকরো দেশ হলো নর্থ এন্ডের এক কাপ কফি। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে চট্টগ্রামের কফি বিন, যেটা পুরোপুরি বাংলাদেশি পণ্য। নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স বাংলাদেশেই এই কফি চাষ, রোস্ট ও প্যাক করে যেন মমতা নিয়ে একেবারে আমার জন্যই তৈরি করে রাখে।

বাঙালি হিসেবে আমাদের জীবন অবশ্য শুরু আর শেষ হয় এক কাপ দুধ চা দিয়ে। চায়ের কাপ হাতে আমরা গোল হয়ে বসে বসে গল্প বুনি আর গল্পে গল্পে হারিয়ে যাই। আমাদের এসব 'আড্ডা' অন্য কারো মতো নয়। বন্ধুত্ব, প্রেম-ভালোবাসা কিংবা প্রতিদিনের জীবন- কী থাকে না আমাদের সেই চায়ের আড্ডায়! আমাদের প্রজন্মের জন্য, সম্ভবত পরবর্তী প্রজন্মের অনেকের জন্যও, দুধ চায়ের জায়গাটা নিয়ে নিচ্ছে কফি।

পর্তুগিজ সাওদাদের ভার কিছুটা প্রশমিত করে ড্যানিশ শব্দ হিউগা (Hygge)! এই শব্দটিকেও বাংলায় এক কথায় বলা দুষ্কর। শব্দটি দিয়ে শীতের দিনের এক আরামদায়ক অনুভুতির কথা বোঝায়, যে উষ্ণতা কেবল পরিবারের সঙ্গে উষ্ণ পানীয় হাতেই পাওয়া যায়।

স্বাদ, ঘ্রাণ আর টেক্সচার প্রচণ্ডভাবে স্মৃতি নাড়া দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কোনো একটা স্বাদ বা ঘ্রাণ মুহূর্তের মাঝেই আমাদেরকে জীবনের একটা নির্দিষ্ট স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেই সময়ের আবেগকেও আমরা অনুভব করতে পারি। যখন সেই নিঃসঙ্গ প্রতীক্ষার অনুভূতি আবার জেগে ওঠে, তখন সুগন্ধি বিনে তৈরি এক কাপ ফেনিল কফির স্বাদের মাধ্যমে আমি সেই চমৎকার মুহূর্তগুলোতে ফিরে যেতে চাই।

আমি নিজেই তৈরি করি আমার হিউগা। নর্থ এন্ডের সুগন্ধি বিন গ্রাইন্ড করে, গরম আমন্ড মিল্কে ঘন করে বানানো ক্যাপুচিনো আমাকে বার্লিনের অন্ধকার শীতল দিনে উষ্ণতা দেয়। কফির প্রতিটি চুমুক আমাকে মনে করিয়ে দেয়, দুনিয়ার যেখানেই থাকি, নিজের দেশের এই একটা স্বাদকে সঙ্গে রেখে আমি একইসঙ্গে দুটো জায়গায় থাকতে পারি।

এক কাপ কফি হাতে আমি ভিডিও কলে বাংলাদেশে কাজিনদের সঙ্গে আড্ডায় বসে পড়ি, সেই ফেলে আসা দিনগুলোর মতোই। তাদের সঙ্গে আমার বেড়ানোর গল্প করি। ওই সময়টা বারবার মনে পড়ে অর্ধেক জীবন আগে দেশে ফেলে আসা সেই দিনগুলোর কথা। 

আড্ডায় মনে পড়ে সেই স্টোইক ব্লিস কিংবা ফুয়াদ আর মিলার গানের কথা। ফ্যাশনের নামে কী অদ্ভুত সব পোশাক পরতাম মনে করে প্রাণ খুলে হাসি আমরা! আবার শপিং করতে যাওয়ার আগে বা পরে ক্যাফেতে বসে তুমুল সব আড্ডার গল্পও উঠে আসে! অনেকে হয়ত বলবে, এটা কেবল এক কাপ কফি। কিন্তু আসলে তা নয়। এটা একটা স্মৃতি, একটা গল্প, একটা ভরসা, হিউগার মতো এমন একটা আরামদায়ক উষ্ণতার অনুভূতি, যা আমাকে মাতৃভূমির স্বাদ আর ঘ্রাণের কথা মনে করিয়ে দেয়।  

যখন এই দুনিয়াকে অনেক দূরের কোনো হিমশীতল স্থান বলে মনে হয়, সাউদাদ আমার মনকে ঘিরে রেখেছে বলে অনুভব করি, ওই সময়টায় এক কাপ কফিই পারে আমাকে সেই আরামদায়ক পরিচিত উষ্ণতার অনুভূতি দিতে।

অনুবাদ করেছেন আনজিলা জেরিন আনজুম

Comments