ভিনদেশে পড়তে গিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন যেভাবে

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী
ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা পরিচিত মানুষ, নিজের শহর-দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। তাদের জন্য নতুন এক দেশে শুরুর সময়টা কিছুটা কঠিনই বলা চলে। অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকেই মানসিকভাবে কিছু প্রতিকূল সময় পার করতে হয়।

হয়তো আমাদের সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর সুস্থতা বিষয়টি এখনও 'ট্যাবু' বলে এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয় না। আর আমরা যেই ভুলটি করে থাকি, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া কিংবা কাউন্সেলিং মানেই মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত অবস্থা ধরে নিই। বিষয়টি কিন্তু সেরকম না। পশ্চিমা দেশগুলোতে শারীরিক সুস্থতার মতো মানসিক স্বাস্থ্যের নিয়মিত খেয়াল রাখাও রুটিনমাফিক একটি কাজ।

নতুন পরিবেশ এবং একাকিত্ব

যুক্তরাষ্ট্রে নিজ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, সাংস্কৃতিক ভিন্নতা আসলেই প্রভাব রাখে। আমরা বাঙালিরা যতটা 'আড্ডাপ্রিয়' বা 'আন্তরিক', মার্কিন মুল্লুকে এর প্রচলন নেই। আপনি তাদের পাবেন সহমর্মী হিসেবে। সেখানকার মানুষ নিজেদের এবং অপরের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ব্যাপারে খুবই সচেতন।

এ কারণে ক্লাসে সহপাঠীদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা হলেও, বাঙালির সেই আন্তরিকতা খুঁজে পাওয়া দুরূহ। কখনো মনে হয়েছে, দিন শেষ হয়ে আসছে কিন্তু একটা বাক্য বিনিময় করার লোক পাওয়া গেল না! কখনো একটানা বৃষ্টি কিংবা তুষারের দিনগুলোতে যখন কিছুদিনের জন্য ক্লাস, দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন এই খারাপ লাগাটা কাজ করে আরও বেশি। এর উপর কেউ যদি থেকে থাকে এমন যে এর আগে পরিবার ছেড়ে থাকেনি- তাহলে নতুন এই দেশে শুরুর সময়টা আসলেই কঠিন।

সময়ের ব্যবস্থাপনা এবং নানান হিসেব-নিকেশ

সত্যি বলতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে এবং আমাদের দেশে পড়াশোনার ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে অনেক পার্থক্য। একজন গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীকে দিনের অর্ধেকের বেশি সময় পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকতে হয়। এর ওপর থাকে অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে ক্লাস, গবেষণার দায়িত্ব, নিজের ঘর কিংবা ডর্ম গোছানো, বাজারসদাই থেকে শুরু করে বহু রকমের কাজ। এমনও দিন গেছে, সারাদিন কাজে ব্যস্ত থাকার পরেও মনে হয়েছে, সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে পারিনি। দেখা গেছে, কয়েক ঘণ্টা চলে যাচ্ছে কিন্তু হোমটাস্ক শেষ হয়নি। প্রায়ই একঘেয়েমি নিয়ে মনে হতো, আমার সহপাঠীরা এত নিখুঁতভাবে সব কাজ কীভাবে করছে!  

আবার সময়ের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত হয় খরচের হিসেব। যুক্তরাষ্ট্রে ডর্ম বা বাসা ভাড়া তুলনামূলকভাবে বেশি। আবার সব স্টেটে খরচও এক নয়। তাই একজন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে অনেক হিসেব করেই চলতে হয়। বেশ কয়েকজন সহপাঠীকে দেখেছি সিঙ্গেল মাদার। তাদের জন্য হিসেবের খাতাটা আরেকটু বেশি পরিকল্পনামাফিক। 

আবার কখনো গ্রীষ্মকালীন সময়ে অ্যাসিসট্যান্টশিপ থাকে না। সে সময়টায় মনমতো সামার জব পাওয়া, ট্যাক্স, সব মিলিয়ে যোগ হয় আরও হিসেবনিকেশ। মূল কথা, পড়াশোনা এবং এত সব কাজের মাঝে তখন হিসেবনিকেশ করতে কার ভাল লাগে!

এসব কিছুও কিন্তু মানসিক চাপের কারণ হয়ে থাকে এবং স্বাভাবিকভাবেই এর প্রভাব পড়ে পড়াশোনায়।

তবে অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, আসলে শুরুর দিকে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমার অ্যাডভাইজর বলতেন, কোনো কারণে মানসিকভাবে একঘেয়ে কিংবা বিষণ্ণ বোধ করাটা কিন্তু স্বাভাবিক। এই বিষয়টাকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে মনেরও খেয়াল রাখতে হবে।

তাই প্রথম সেমিস্টার কিংবা এক বছর খারাপ লাগবে এমনটা ধরে নিয়েই দিনের কাজগুলো দিনেই গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে সপ্তাহের পরিকল্পনা করে নেওয়া যায়। এও মনে রাখতে হবে, শুরুর দিকে ফলাফল খুব ভাল নাও হতে পারে। যেহেতু সময়টা নিজেকে নতুন এক পরিবেশে গুছিয়ে নেওয়ার তাই এই বিষয়টাই আপাতত গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে যে বিষয়গুলো এ সময়টায় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন-

কয়েকজন ভালো বন্ধু

যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সময় প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও এই বোধটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কয়েকজন ভালো বন্ধুর কারণেই। প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হওয়ায় ভিনদেশে অনেকটা পরিবারের মতই একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা গড়ে ওঠে। ছুটির দিনে নানা ইনডোর গেমস, একসঙ্গে বাজারসদাই, ওয়ান ডিশ পার্টি, সবকিছুই ছিল আমাদের কর্মব্যস্ততার মাঝে আনন্দ। এমনকি কারো অসুস্থতা, মন খারাপেও এই বন্ধুমহল সাহায্য করেছে অনেক। 

বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিস

একঘেয়েমি কিংবা একাকীত্ব কাটানোর জন্য নিজের ভালো লাগে এমন অ্যাক্টিভিটিস করা যেতে পারে। আমার সহপাঠীদের দেখেছি কেউ ইনডোর প্ল্যান্টস, গ্রীষ্মে বাগান করা নিয়ে ব্যস্ত। আবার কেউ অবসরে পেইন্টিং, নানান স্পোর্টস অ্যাক্টিভিটিসে নিজেদের ব্যস্ত রাখছে। এই ইনডোর এবং আউটডোর অ্যাকটিভিটিসগুলো অনেকটা নির্ভার থাকতে সাহায্য করে। আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে হয় জিমনেশিয়াম কিংবা অ্যাসোশিয়েশনের বিভিন্ন কাজ। পড়াশোনার একঘেয়েমি কিংবা পরিবার থেকে এত দূরে থাকবার যে একাকীত্ব তা অনেকটাই ভুলে যেতাম এসব কাজে ব্যস্ত থাকলে। এতে নতুন কিছু শেখার পাশাপাশি অনেকের সঙ্গে পরিচয়ও হয়।

মানসিক সুস্থতার বিষয়ে কোনো সংকোচ না রাখা

যেমনটা আমার অ্যাডভাইজার বলেন, কোনো সংকোচ ছাড়াই খারাপ লাগা, বিষণ্ণতা হলে তা কাছের কাউকে জানানো। হতে পারে কোন বিশ্বস্ত বন্ধু, অ্যাডভাইজার কিংবা কাউন্সেলর। বহির্বিশ্বে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই কাউন্সেলিংয়ের সুযোগ রয়েছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ব্যয় শিক্ষার্থীর ইনস্যুরেন্সের মধ্যেই থাকে। প্রয়োজনে নিজ অ্যাডভাইজার, কিংবা গ্র্যাজুয়েট স্টাডিজর পরিচালককে বিষয়টি জানানো।

পড়াশোনা, কাজ কিংবা গবেষণা যত যাই হোক, নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া দরকার সবকিছুর আগে। 

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh, Pakistan, China launch trilateral cooperation mechanism

A working group will be formed to follow up on and implement the understandings reached during the meeting

1h ago