আসুন পরিচিত হই বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের সঙ্গে

বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট টিম

বাংলাদেশের মানুষ ক্রিকেটপ্রেমী। এখানে প্রতিটি অলি-গলি আর স্কুলের আঙিনা প্রতিদিন মুখরিত হয় ক্রিকেটের স্পন্দনে। সেই দেশের বুকেই একদল খেলোয়াড় আছেন যারা জাতীয় দলের জার্সি পরার আবেগকে অন্য উচ্চ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।

হয়তো তাদের ব্যাটের সুইং নিয়ে গণমাধ্যম মাতোয়ারা হয় না কিংবা তাদের ম্যাচ দেখতে গ্যালারি উপচে পড়ে না। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের আছে আলাদা গল্প। যে গল্প শুনলে শক্তি সম্পর্কে আপনার ধারণা বদলে যাবে। তারা বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের যোদ্ধা, যারা খেলেন নিজের মর্যাদার জন্য।

যে দলনেতা স্বপ্ন দেখেছিলেন

মাত্র ছয় মাস বয়সে পোলিও রোগ হাঁটার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল মোহাম্মদ মহসিনের। কিন্তু খেলাধুলার প্রতি তার যে ভালোবাসা তা কেড়ে নিতে পারেনি।

বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল

মহসিন বলেন, '৯০ দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ যখন আইসিসি ট্রফিতে জয় পেল, পুরো দেশ ক্রিকেট জ্বরে ভুগছিল। সেসময় আমি হামাগুড়ি দিয়ে বাড়ির কাছের মাঠে যেতাম এবং যে ছেলেরা ক্রিকেট খেলত তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এ কারণে প্রায়ই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করা হতো, আমাকে পেছনে ফেলে যেত সবাই। এসব বিষয়ে আমি কষ্ট পেতাম। ভাবতাম, আমার মতো মানুষদের যদি আলাদা দল থাকত, তাহলে কেমন হতো?'

২০১০ সালে মহসিনের সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করে। তিনি নিজেই হুইলচেয়ারে বসে ক্রিকেট খেলার একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন। মহসিনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, শারীরিক প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ক্রিকেটারদের নিয়ে বাংলাদেশে কোনো দল আছে কিনা। জবাবে তিনি বলেছিলেন, 'এখন পর্যন্ত নেই, তবে আমরা এমন দল গঠন করব।'

এরপর বিভিন্ন স্থানে ইমেইল ও টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে শুরু করেন তিনি, শুরু করেন হুইলচেয়ার ক্রিকেটের পক্ষে প্রচারও। এরপরই নেন একটি সাহসী পদক্ষেপ, আর সেটি হলো সব মানুষের সুগম চলাচলের অধিকারের পক্ষে সচেতনতা বাড়াতে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত হুইলচেয়ার যাত্রা। তার এই পদক্ষেপ সবার নজর কাড়ে। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে শুরু করে মহসিনের আওয়াজ।

তিনি বলেন, 'আমরা প্রমাণ করেছি যে শারীরিক অক্ষমতা কোনো সীমাবদ্ধতা নয়, বরং সমাজের প্রথাগত মানসিকতা। প্রতিবন্ধিতা আমাদের বাধা নয়, আমাদের বাধা সমাজ।'

এক সময় অনেকে তাকে ভিক্ষুক ভেবে ভুল করেছিল, অপরিচিত কেউ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হাতে পয়সাও দিয়ে গিয়েছিল, সেসব গল্পও করলেন মহসিন।

তিনি বলেন, 'অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন আমার স্ত্রীও আমার মতো কি না। অনেকে জানতে চান, আমার সন্তানরা স্বাভাবিক কি না। এ সম্পর্কে আসলে সচেতনতার এত অভাব!'

দেশে ২০০৭ সালের প্রতিবন্ধী অধিকার আইন বিদ্যমান থাকলেও তার প্রয়োগ অত্যন্ত দুর্বল বলে জানালেন মহসিন।

তিনি বলেন, 'এমনকি প্রতিদিন যে নতুন নতুন ভবন তৈরি হচ্ছে সেগুলোতেও হুইলচেয়ারের জন্য র‌্যাম্পের ব্যবস্থা রাখা হয় না। আসলে এটি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নয়, বরং মানসিকতার বিষয়।'

যে অলরাউন্ডার লড়েছেন একটি মাঠের জন্য

মো. রাজন হোসেনের কণ্ঠ বেশ শান্ত, তবে তিনি যখন কথা বলেন তখন তা খুব গভীরে প্রবেশ করে।

বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট টিম

তিনি বলেন, 'মানুষ মনে করে আমাদের ধাক্কা দিয়ে সামনে এগিয়ে দেওয়া লাগবে। কিন্তু তারা জানে না যে আমরা হুইলচেয়ারে বসে ক্রিকেট খেলি।'

দুই বছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হলে বদলে যায় রাজনের জীবন। কোমর থেকে নিচের অংশের নড়াচড়া সীমিত হয়ে যায়। কিন্তু পোলিও তার ইচ্ছাশক্তিকে কেড়ে নিতে পারেনি। হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলে যোগ দেওয়ার পর এটি তার জন্য কেবল খেলা নয়, বরং ভাতৃত্বের বন্ধন।

রাজন বলেন, 'আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে একটি কংক্রিটের কোর্টে প্রশিক্ষণ নিতাম। কিন্তু সেখানে এখন আর প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায় না। বহু বছর ধরে শুনে আসছি যে কেবল হুইলচেয়ারে ক্রিকেট খেলার জন্য আমরা একটি মাঠ পাব, যেমনটি সংসদ ভবনের কাছে রয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বাস্তব রূপ দেখতে পাইনি।'

এমনকি অবকাঠামোগত কারণে নিয়মিত অনুশীলন করাও দুষ্কর। দলের বেশিরভাগ সদস্য অনুশীলন করতে যাওয়ার মতো পরিবহন খরচ জোগাড় করতে পারেন না, গণপরিবহনে তো ওঠাই যায় না। যখনই সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা সঙ্গে হুইলচেয়ার দেখেন, তারা অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকেন। এই দলের জন্য স্পন্সরও কম পাওয়া যায়।

রাজন বলেন, 'ভারত বা নেপালে হুইলচেয়ারে খেলার জন্য সমান করে ঘাস ছেঁটে মাঠ তৈরি করা হয়। আর আমরা আগাছা আর খানা-খন্দে ভর্তি মাঠে অনুশীল করি। এটি সত্যিকার অর্থেই আমাদের পথচলার গতি কমিয়ে দেয়।'

ছোট একটি কম্পিউটারের দোকান আছে রাজনের। এরমধ্যেই খেলাধুলার জন্য সময় বের করেন।

তিনি বলেন, 'আমরা লড়াই করছি। আমাদের লড়াই কেবল খেলার জন্য নয়, বরং মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার জন্য।'

খাদের কিনার থেকে উঠে আসা সহ-অধিনায়ক

১৫ বছর বয়সে বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়েছিলেন মো. রিপন উদ্দিন। এতে তার মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়। এই দুর্ঘটনার পর সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু রিপনের ক্ষেত্রে তা হয়নি।

বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দল

হুইলচেয়ারে বসেই রিপন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। কলেজের ইতিহাসে প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং বৃত্তি নিয়ে ফাইন্যান্স বিভাগ থেকে বিবিএ ও এমবিএ শেষ করেন।

রিপনের জীবনে ক্রিকেট আসে ২০১৫ সালে, মোহাম্মদ মহসিনের হাত ধরে।

রিপন বলেন, 'বড় হওয়ার সঙ্গে দেখতে পেলাম বাংলাদেশের খেলাধুলার জগতে আমাদের মতো মানুষের জন্য কোনো জায়গা নেই। পরিবারগুলোও প্রতিবন্ধী শিশুদের বোঝা হিসেবে দেখে। এখানে অক্ষমতাকে অভিশাপ হিসেবে দেখা হয়।'

২০১৭ সালে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক হুইলচেয়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। সেখানে যোগ দিয়েছিল ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের দল। সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দল জয় পায়। সেই জয় থেকেই জন্ম হয় ইন্টারন্যাশনাল হুইলচেয়ার ক্রিকেট কাউন্সিল (আইডব্লিউসিসি), মহসিন যার সাধারণ সম্পাদক। এরপর থেকে আয়োজন করা হচ্ছে বিভাগীয় টুর্নামেন্ট, যেগুলো দেশজুড়ে নতুন আশার সঞ্চার করছে।

রিপন বলেন, 'কিছু খেলোয়াড় ক্রাচ বা হাতে তৈরি বোর্ড ব্যবহার করতেন। তাদের অনেকের তো হুইলচেয়ারও ছিল না। এখন তারাই নিজ নিজ বিভাগের প্রতিনিধিত্ব করেন, পতাকা বহন করেন।'

তবে এতকিছুর পরেও খেলোয়াড়রা সহজেই সব পেয়ে যান না উল্লেখ করে রিপন বলেন, 'কিছু স্পন্সর আমাদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন যেন আমরা কেবলই কনটেন্ট, যা প্রচারের জন্য ভালো কিন্তু বিনিয়োগের জন্য খারাপ। অনেক দলের ব্যবস্থাপক তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ করেন। কেউ কেউ নিজের ব্র্যান্ড ইমেজের জন্য আমাদের উদ্যোগকে অনুকরণও করেন।'

এরপরেও অবিচল কণ্ঠে রিপন বলেন, 'আমরা কারো করুণা চাই না। আমরা কেবল চাই সুযোগ।'

নিজেকে দৃশ্যমান করতে মাঠের বাইরেও লড়াই

বাংলাদেশ হুইলচেয়ার ক্রিকেট দলের সংগ্রাম দেশের প্রায় এক কোটি প্রতিবন্ধী মানুষের দুর্ভোগের প্রতিফলন যেন। দুর্গম পরিবহন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রতিকূল কর্মক্ষেত্র, সবখানেই যেন বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করাই রয়েছে।

মহসিন বলেন, 'বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বিশাল বাজেট আছে। তারপরেও তাদের কাছ থেকে আমরা খুব কমই সহায়তা পেয়েছি। যদি সত্যিই দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশ তৈরি হতো, তাহলে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে অন্তত একজন প্রতিবন্ধিতাসম্পন্ন ব্যক্তি নিয়োগ পেতেন। তখন বলা যেত যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা এমন দেখতে হয়।'

নানা সীমাবদ্ধতার পরেও দলটি মার্কিন দূতাবাস ও ইউএনডিপির মতো সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছে। এই খেলোয়াড়রা আয়োজন করেছেন ম্যাচ, সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছেও গেছেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হুইলচেয়ার ক্রিকেট খেলার চেয়েও বেশি কিছু। এটি শেখায় কীভাবে সমাজ নির্ধারিত সীমানা ভেঙে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। এটি সেই মানুষদের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর, একটা দীর্ঘ সময় যাদের মূলধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। যে কণ্ঠস্বর উঠে আসে ব্যাটে বলের আঘাতের শব্দের মধ্য দিয়ে। এই খেলোয়াড়দের প্রাপ্য কেবল সবার মনোযোগ পাওয়া নয়, বরং অন্য সবার সঙ্গে সমানভাবে পথ চলার অধিকার। আলাদা শক্তি হিসেবে নয়, সমাজের মূলধারার সঙ্গে তাদের চলার সুযোগ চান তারা।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

From subsistence to commercial farming

From the north-western bordering district Panchagarh to the southern coastal district Patuakhali, farmers grow multiple crops to sell at markets

1h ago