কালাচাঁদপুর: ঢাকার বুকে এক ভিন্ন সংস্কৃতির ছোঁয়া

কালাচাঁদপুর
ছবি: স্টার

বারিধারার ডিপ্লোমেটিক জোন ও বারিধারা ডিওএইচএসের পেছন দিকটার নাম কালাচাঁদপুর। এটি এক জাঁকজমক মহল্লা, যাতে ক্লান্তির কোনো রেশ নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই অঞ্চলটি ভীষণভাবে পরিচয় সংকটে ভোগে।

কারণ এখানকার বাসিন্দারা জায়গার নাম কখনো বলেন বাড্ডা, কখনো উত্তর বাড্ডা, গুলশান, বারিধারা ইত্যাদি। যদিও ওয়ার্ড-১৮, ডিসিসি (কোতোয়ালী), ঢাকার একটি অংশ হিসেবে কালাচাঁদপুর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়েছে, তবু নামের ক্ষেত্রে এ নাম নেন কম লোকেই। এই জায়গাটি শহরের মানচিত্রে নদ্দার কাছাকাছি অবস্থিত।

এই চিপাগলি গোছের জায়গাটি আসলে কোথায় অবস্থিত, সেটি বোঝাতে গেলে গুলিয়ে যায় এর ডাকঘরের ঠিকানা পর্যন্ত। আর যারা কি না এর বাইরের লোকজন, মানে ওই অভিজাত ত্রি-মোহনায় থাকেন, তারা তো কালাচাঁদপুরের বাসিন্দাদের প্রতিবেশী ঠাওরাতেই চোখ মাথায় তোলেন। এদের মধ্যকার শত্রু শত্রু খেলাটা যেন ছোটবেলায় পড়া সেই শহুরে ইঁদুর আর গেঁয়ো ইঁদুরের মধ্যকার টানাহ্যাঁচড়াকেই মনে করিয়ে দেয়।

কালাচাঁদপুর, বারিধারা কিংবা গুলশানের মধ্যকার রাস্তাঘাটের মানচিত্র কী, তা এক্ষেত্রে খুব একটা ভূমিকা পালন করে না। এদের মধ্যকার সীমারেখাও তাই বেশ অস্পষ্ট মনে হয়। এটিকে মনে হয় এসব এলাকার মধ্যকার একটি অঞ্চল, যা কি না সহাবস্থানে থেকে যায়।

কালাচাঁদপুরকে অপেক্ষাকৃত অস্বচ্ছল মানুষজনের জায়গা মনে করা হয়। কিন্তু ঢাকা শহরের জাদু তো এর বসবাসের অঞ্চল বা দোকানপাটের বিভাজনে নয়, তাই ঢাকার অন্যতম হৃদয়স্থল হিসেবে এই এলাকাটি জ্বলজ্বল করে বেঁচে থাকে।

কালাচাঁদপুরের সরু অলিগলিতে মিলেমিশে যায় এর অকৃত্রিম আবেগ, যা এই শহরেরই প্রাণ। এছাড়াও ঢাকায় বসবাসরত কর্মজীবী গারো সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা করে এই এলাকাটির নাম নেওয়া যায়।

গারোরা মূলত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে বসবাসরত আদিবাসী গোষ্ঠী। ঢাকায় তাদের আসার কারণ হিসেবে দুটো বিষয় উল্লেখ করা যায়। পড়াশোনা ও কর্মসংস্থান। তাই মজা করে অনেকে কালাচাঁদপুরকে গারো অ্যাম্ব্যাসিও বলে থাকেন। কারণ এই জায়গায় এই কর্মনিষ্ঠ গোষ্ঠী নিরাপদ বাসস্থান খুঁজে পেয়েছেন। পুরোনো বাসিন্দারা নতুনদের এমনভাবে জায়গা করে দেন, মনে হয় যেন ফেলে আসা গ্রামেরই আত্মীয়তা গড়ে ওঠে এখানে। তাইতো এ অঞ্চল তাদের বড় আপন বলে মনে হয়।

তাদের আনাগোনাতে কালাচাঁদপুরের অলিগলি আনন্দে মেতে ওঠে। নিজেদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক দোকমান্দা পড়ে তারা নিজেদের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যে ভরিয়ে তোলেন পথঘাট। স্বাধীন স্বাতন্ত্র্যে বাঁচেন গারো সম্প্রদায়ের এই মানুষগুলো।

নিয়মিত কর্মযজ্ঞের পর নিজেদের প্রতিদিনের কেনাকাটা, সামাজিক মেলামেশাও চলে এখানে। রাতের জীবনযাপনও খুব উদযাপনের হয় এখানে। কেনাকাটার দ্রব্যাদিতেও থাকে বিশেষত্বের ছোঁয়া। রাতের বেলা এখানকার রাস্তাঘাট আলোতে ভাসে, মনে হয় যেন ঢাকায় উঠে এসেছে এক টুকরো ব্যাংকক! দারুণ সব বৈচিত্র্যময় খাবারের স্বাদে এখানকার নিত্যদিনের জীবনযাপন মুখর হয়ে থাকে।

এ অঞ্চলের ঝালমুড়ি বিক্রেতার কাছে পাওয়া যায় অদ্ভুত সুস্বাদু বোম্বাই মরিচ বা নাগা মরিচ মেশানো ঝাল ঝাল ছোলা আর মুড়িমাখা। প্রতিদিন তার বেচাবিক্রি হয় ৭ হাজার টাকারও বেশি। এছাড়া উৎসব-অনুষ্ঠান হলে তো কথাই নেই।

পার্শ্ববর্তী বাজারগুলোতে গারোদের বাহারি খাদ্যের পসরা বসে। এশিয়ান সোয়াম্প ঈল বা কুইচ্চা বাইম, শামুক, শামুকের ডিম, নাপ্পি বা চিংড়ির চাটনি, বাঁশকোড়ল, কচুর ফুল, আদা ফুল ইত্যাদি বিশেষ সব খাবারই মেলে এখানে।

কালাচাঁদপুরের সেইন্ট পল'স গীর্জা আছে। ফলে গারোদের ধর্মীয় চর্চাতেও কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। একইসঙ্গে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা নিয়োগকারী লোকজনের কাছেও এই অঞ্চলটিতে থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা রয়েছে। হেঁটে যাওয়া যায়– এমন দূরত্বে, কর্মক্ষেত্রের এতটা কাছাকাছি থাকতে পারার সুযোগ থাকায় এই সম্প্রদায়ের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটছে। এর ফলে বাড়ছে কালাচাঁদপুরের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও।

এখানকার অনেক তরুণ-তরুণী আশপাশের বিভিন্ন বিউটি পার্লার ও সেলুনে মাসিউজি ও হেয়ারড্রেসারের কাজ পেয়েছেন। এর কিছু অংশ আবার গৃহকর্মী, গার্মেন্টস কর্মী, ড্রাইভার, নিরাপত্তা রক্ষী, নির্মাণ শ্রমিক— এমনকি নার্সের পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। কল সেন্টার, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা কোম্পানিতে গারোদের একটি বর্ধিষ্ণু অংশ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন।  

ঢাকার কেন্দ্রস্থলে 'সংস্কৃতির মধ্যে অন্য এক সংস্কৃতি'র দেখা মেলে কালাচাঁদপুরে। তাই তো আরো জাদুময় মনে হয় এই এলাকাটিকে।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English

Reforms, justice must come before election: Nahid

He also said, "This generation promises a new democratic constitution for Bangladesh."

3h ago