নড়াইলে ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরার গল্প জানেন?

ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা
ছবি: রনি শরাফত

নড়াইলের খালগুলোর ঘোলা জলে এখনও টিকে আছে মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যকার এক অনন্য প্রাচীন সম্পর্ক। এই সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে, আরও নির্দিষ্ট করে বললে জেলে সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে ভোঁদড়ের।

সেখানে একজন জেলে পানিতে জাল ফেলেন, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ঝাঁপ দেয় তার পোষা ভোঁদড়ও। এমন নয় যে, জাল ফেলার সঙ্গে সঙ্গে ভোঁদড়ের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার বিষয়টি সহজাত। আসলে বছরের পর বছর মানুষের সঙ্গে এই প্রাণীর যে সহাবস্থান, যে বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, সেটিরই সমন্বয় এটি। তথ্যচিত্র নির্মাতা ও আলোকচিত্রী রনি শরাফাতের `দ্য লাস্ট ফোকস অব ওটার` শীর্ষক তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকারের এই বিরল দৃশ্য। হতে পারে এটিই বিলুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্যের শেষ ঝলক।

ভোঁদড়
ছবি: রনি শরাফত

বন্যপ্রাণী বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করবেন, এমন কথা মাথায় রেখে তথ্যচিত্রটি নির্মাণ শুরু করেননি রনি। বরং এই তথ্যচিত্রের কাজে তার প্রবেশটাই ছিল দারুণ আকস্মিক।

সেই সময়ের স্মৃতি উল্লেখ করে রনি বলেন, `আমি ২০২০ সালের শেষের দিকে একটি দলের সঙ্গে কাজ শুরু করি যাদের মূল কাজ ছিল বিয়ে নিয়ে। অবশ্য তথ্যচিত্র নিয়েও তাদের আলাদা একটি শাখা ছিল।`

সেই শাখাটিই রনিকে ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিং জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যার পেছনে একটি উদ্দেশ্যও ছিল। আর সেটি হলো চ্যানেল ফোর এবং দ্য ইকোনমিস্টের মতো বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কাজ করা। কিন্তু শরাফতের আগ্রহ তৈরি হয় অন্যকিছুর প্রতি। তিনি চাইছিলেন এমন সব গল্প তুলে আনতে যা এতদিন উপেক্ষিত ছিল, বিলীন হওয়ার পথে বা যা এতদিন কারও নজরেই আসেনি।

তিনি যে তথ্যচিত্রের কাজ করেন, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভুল ধারণা রয়েছে বলে জানান শরাফত।

ভোঁদড়
ছবি: রনি শরাফত

'সবাই মনে করেন, আমি হয়তো ইউটিউবের জন্য ভ্লগ বানাই অথবা এসব ভিডিও তৈরি করে প্রচুর আয় করি। কিন্তু এর থেকে আসলে সরাসরি কোনও আর্থিক লাভ হয় না। আমি আসলে যা করি তা মূলত পোর্টফোলিও তৈরির জন্য এবং সম্ভবত মানুষের কাছ থেকে কিছু আস্থা অর্জনেও', তিনি বলেন।

শরাফত বলেন, এই আস্থা প্রয়োজন হয় তখন যখন আপনি ঝুঁকিপূর্ণ বা অবহেলিত জনপদের মানুষের ওপর কাজ করবেন। কারণ আজকাল বাংলাদেশে এত বেশি কন্টেন্ট তৈরি হচ্ছে আর এত বেশি ক্যামেরা মানুষের জীবনে প্রবেশ করছে যে তা অনেকের জন্যই অস্বস্তিকর। তাই তাদের ভেতরে ঢুকে কাজ করতে চাইলে আস্থা অর্জন জরুরি।

তিনি আরও বলেন, 'অনেকেই আছেন যারা একটি ক্যামেরা আর লেন্স নিয়ে এসেই চিত্রগ্রহণ করতে শুরু করেন। শুরুতেই যে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সহজ করে নিতে হয়, সে বিষয়টি তারা এড়িয়ে যান। এটা নৈতিকভাবে সঠিক নয়। আপনি যদি সম্মতি না নিয়ে ভিডিও করতে শুরু করেন তাহলে তো স্থানীয় মানুষ রেগে যেতেই পারেন।'

যখন শরাফত নড়াইলের জেলে সম্প্রদায়ের ওপর তথ্য সংগ্রহের জন্য গিয়েছিলেন, তখন এটি বিশেষভাবে তার জন্য সত্য ছিল। তিনি তো কেবল ভোঁদড় ব্যবহার করে মাছ ধরার দৃশ্য ভিডিও করতে যাননি, তিনি তাদের গল্পও শুনতে চেয়েছিলেন। এই পদ্ধতিতে মাছ ধরা একটি শতাব্দী প্রাচীন পদ্ধতি যেখানে প্রশিক্ষিত ভোঁদড়রা পানিতে নেমে জালে মাছ ঢুকতে সাহায্য করে।

ভোঁদড়
ছবি: রনি শরাফত

বর্তমানে হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন মানুষ এই প্রাচীন পদ্ধতি ব্যবহার করে মাছ ধরেন।

শরাফত বলেন, 'আমি অনেক আগে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির একটা তথ্যচিত্রের মাধ্যমে এই পদ্ধতির কথা জানতে পারি। তখন আমি ভিডিও তৈরির কাজে যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু তখনই আমি ঠিক করেছিলাম, ভোঁদড় দিয়ে মাছ ধরা সরাসরি আমাকে দেখতেই হবে।'

নানা পরিকল্পনার পর শরাফত যখন নড়াইলে গিয়ে পৌঁছলেন তখন যা দেখলেন তা একদিকে যেমন মনোমুগ্ধকর ছিল তেমনি ছিল বিষণ্নও।

তিনি বলেন, `এখন মাত্র দুই বা তিনটি পরিবার কেবল এই পদ্ধতিতে মাছ ধরে। বাকিরা জীবিকার তাগিদে অন্য পথ বেছে নিয়েছে। এমনকি ভোঁদড় প্রজাতির প্রাণীটিও বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। জলবায়ু পরিবর্তন, পানি দূষণ এবং নিয়মনীতি না মেনেই বিষ দিয়ে মাছ ধরার মতো প্রবণতা ভোঁদড়ের প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎসগুলো নষ্ট করে দিয়েছে।'

শরাফতের ভিডিওচিত্রে মানুষের সঙ্গে ভোঁদড়ের গভীর সহাবস্থানের চিত্র ফুটে উঠেছে। খুব ছোটবেলা থেকেই এই ভোঁদড়দের লালনপালন করা হয়, আর এই প্রাণীরাও তাদের লালনপালনকারীদের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখে। আর জেলেরা যে কেবল মাছ ধরার জন্যই ভোঁদড় পালেন, বিষয়টা ঠিক তেমনও নয়। বরং প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা তাদের যে জীবনব্যবস্থা, জীবনের যে ছন্দ, তার সঙ্গেও ভোঁদড় জড়িয়ে আছে।

'জেলেরা ভোঁদড়দের কোনো ক্ষতি করে না। যখন পানিতে নামানো হয় তখন দড়ি বেঁধে রাখা হয় যেন এগুলো সাঁতার কেটে অন্য কোথাও চলে না যেতে পারে। ভোঁদড়ের সঙ্গে মানুষের বন্ধনটি ভীষণ দৃঢ়, বিশেষ করে তাদের সঙ্গে, যাদের পরিবারের সদস্য হিসেবে এসব প্রাণী বেড়ে উঠেছে।'

ঐতিহ্যবাহী এই পদ্ধতিটি কেবল পরিবেশগত কারণেই বিলুপ্তির পথে, বিষয়টি তেমনও নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে অর্থনৈতিক বিষয়ও।

শরাফত বলেন, `এটি কঠোর পরিশ্রমের। মাছ ধরার জাল বসিয়ে তা আবার টেনে আনা খুবই পরিশ্রমের কাজ। জেলেদের অনেকেই দীর্ঘস্থায়ীভাবে পিঠ ব্যথার সমস্যায় ভুগছেন। আর তরুণ প্রজন্ম? তারা এই কাজে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখতে পান না।'

'দ্য লাস্ট ফোকস অব ওটার ফিশিং' তথ্যচিত্র নির্মাণে শরাফতের সঙ্গে আর কেউ ছিলেন না।

তিনি একাই ভিডিও ধারণ করেছেন, প্রযোজনা এবং সম্পাদনার কাজ করেছেন। ভ্রমণের খরচও নিজেই বহন করেছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমি যখন ভিডিও ধারণ করি তখন জেলেদের কিছু অর্থ দিয়েছিলাম। এজন্য নয় যে তাদের দৃশ্যধারণ করছিলাম, এজন্য যে তারা আসলেই ভীষণ পরিশ্রমের কাজ করেন। এরপর কয়েকজন বিদেশি পর্যটক আসেন এবং তারাও গোটা বিষয়টা প্রত্যক্ষ করার পর জেলের অর্থ সহায়তা করেন। এভাবে এটি কমিউনিটি ট্যুরিজম বা গোষ্ঠীগত পর্যটনের একটি ক্ষেত্রও হয়ে উঠতে পারে।'

শরাফত মনে করেন, এই এলাকায় ভোঁদড় ব্যবহার করে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে একটি তথ্যবহুল ইকোট্যুরিজম গড়ে উঠতে পারে। যা মানুষ ও প্রাণী, উভয়ের জন্যই দারুণ সম্মানজনক হবে।

তিনি বলেন, `এই গ্রামের মানুষেরা খুব আনন্দের সঙ্গে অন্যদের স্বাগত জানায়। কিছু মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া গেলে এই এলাকাটি টেকসই পর্যটনের দারুণ কেন্দ্র হতে পারে।`

কিন্তু তথ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে আসলেই কি ক্ষয়িষ্ণু কোনোকিছুকে বাঁচিয়ে রাখা যায়?

'ভিডিও রাতারাতি নীতিগত কোনও পরিবর্তন এনে দিতে পারবে না', স্বীকার করেন শরাফত।

তিনি বলেন, 'কিন্তু এর মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি সম্ভব। অন্তত এটার প্রমাণ থাকছে যে, একসময় এই পদ্ধতিতে মাছ ধরা হতো।'

ভবিষ্যতে তিনি মানুষ-প্রাণীর সম্পর্কের এই ধরনের আরও গল্প শোনাতে চান। যার মধ্যে রয়েছে টেকনাফ ও শেরপুরে বন্য হাতির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান।

'অনেক মানুষ জানেও না যে ওই অঞ্চলে হাতি আছে। সবসময় এমন গল্প প্রচার করা হয় যে, হাতিরা ঘরবাড়ি ধ্বংস করে ফেলবে বা মানুষকে মেরে ফেলবে। কেউ সহাবস্থানের কথা বলে না', তিনি বলেন।

শরাফতের দৃষ্টিভঙ্গি কেবল লোক দেখানোর জন্য নয় বরং দায়িত্বের খাতিরে তিনি এসব কাজ করতে চান। তিনি তার ক্যামেরার লেন্সকে বিস্ময় জাগানোর হাতিয়ার হিসেবে দেখতে চান না, বরং দেখতে চান সূক্ষ্ম সব বিষয় সংরক্ষেণর মাধ্যম হিসেবে।

'আমরা প্রকৃতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছি। আর এখন সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই দ্রুত সবকিছু নথিভুক্ত করে রাখতে হবে', যোগ করেন শরাফত।

'দ্য লাস্ট ফোকস অব ওটার ফিশিং' তথ্যচিত্রের মাধ্যমে কোনো সমস্যার সমাধান বাতলে দেননি শরাফত। তিনি যা দিয়েছেন তা আরও বিরল। তিনি তুলে ধরেছেন এক নীরবতার গল্প, মানুষ আর প্রাণীর সহাবস্থানের অনন্য চিত্র। শরাফত বলেছেন এমন এক গল্প, যা বলার এখনই সময়। কারণ এখনই যদি গল্পটি না বলা হয়, তাহলে হয়তো আর কখনোই তা বলা হবে না।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

  

Comments

The Daily Star  | English
Exporters to get Tk 108.5 for a dollar from Aug 1

Taka gains against dollar after years

Taka gains ground as dollar influx rises, strengthening currency after years

1h ago