সঙ্গী যদি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়

কেউ কেউ সঙ্গীর পরিবার ও বন্ধুর পরিসর ছোট করে আনার জন্য চাপ দেন, ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেন, নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, এমনকি সঙ্গীর ভালো-মন্দের সিদ্ধান্তও নিয়ে থাকেন।
সঙ্গী নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে
ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রিমা (ছদ্মনাম) পছন্দ করেন শাড়ি পরতে আর তার প্রিয় কাজ আড্ডা দেওয়া। কিন্তু বয়ফ্রেন্ড শ্রেয়াসের (ছদ্মনাম) তার শাড়ি পরা বা বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া মোটেও পছন্দ না। এ নিয়ে কথার ঝড় বয়ে যায় দুজনের মাঝে। অশান্তি এড়াতে শেষমেশ রিমা মেনে নেন শ্রেয়াসের কথা। কিন্তু তাদের সম্পর্কে আগের মতো উচ্ছ্বাস আর দেখা যায় না।

আড্ডার জৌলুস বাড়ানো নিলয়ও (ছদ্মনাম) কেমন যেন বদলে গেছেন। আজকাল তাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। বন্ধুদের এক পারিবারিক আড্ডায় অবশেষে পাওয়া গেল তাকে, কিন্তু তার আচরণ বেশ জড়সড়। আড্ডার মাঝে কথা বলতে গিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেমে যাচ্ছেন তিনি, কথাও বলছেন মেপে মেপে।

সম্পর্কের ক্ষেত্রে একজন তুলনামূলকভাবে বেশি কর্তৃত্ব খাটিয়ে থাকেন আর অপরজন মেনে নেন ভালোবেসে- এমনটা প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু সেই কর্তৃত্ব খাটানোর স্বভাব অর্থাৎ ডমিনেটিং আচরণ যদি বেশি হয়ে যায়, তাহলে সম্পর্কে তিক্ততা চলে আসে। একটা সময় সম্পর্কে বেজে ওঠে ভাঙনের সুর।

মানুষের মধ্যে একটি লক্ষণীয় আচরণ কর্তৃত্ববাদী বা নিয়ন্ত্রণবাদী আচরণ, যা কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রকট আকার ধারণ করে এবং জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই কর্তৃত্ববাদী আচরণ দেখা যায়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'কর্তৃত্ব হলো এমন এক আচরণ, যা মানুষ পরিবার থেকে শিখে থাকে। তাছাড়া অনেক সময় অপ্রাপ্তি থেকেও মানুষ দিন দিন কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে।'

নিয়ন্ত্রণমূলক বা কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণ কী

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ হলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজস্ব মতবাদ, ইচ্ছা, প্রয়োজন অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া বা অন্যকে করতে বাধ্য করা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, খুব কাছের মানুষদের ওপরেই নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করে মানুষ।

তালে তাল না মেলালেই রেগে যান কর্তৃত্বপরায়ণ ব্যক্তিরা। তাদের ইচ্ছে বা পছন্দের বাইরে কোনো কাজ সঙ্গী করলেই মেজাজ সপ্তমে ওঠে যায়। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে তারাই ঠিক। এক্ষেত্রে ব্যক্তি তার সঙ্গীর পরিবার এবং বন্ধুর পরিসর ছোট করে আনার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন, ব্যক্তিগত বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করেন, নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, গ্যাস লাইটিং, ভীতি প্রদর্শন এমনকি সঙ্গীর ভালো-মন্দের সিদ্ধান্তও  নিয়ে থাকেন। সঙ্গী যদি তার কথা না শোনেন তবে ছেড়ে যাওয়ার ভয়, এমনকি শারীরিক নির্যাতন করতে পারেন তিনি।

কেন এমন আচরণ করে মানুষ

ডা. হেলাল আহমেদ বলেন, নিয়ন্ত্রণবাদী আচরণ মূলত মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি পারিবারিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। কোনো ব্যক্তি যদি তার পরিবারে অতিরিক্ত খবরদারির মধ্য দিয়ে যান বা এটি যদি পারিবারিক চর্চার বিষয়বস্তু হয়ে থাকে, তাহলে পরে তার মধ্যেও কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণ দেখা যায়। তাছাড়া অতিরিক্ত রাগ, সঙ্গীকে হারানোর ভয় বা আগের কোনো নেতিবাচক অভিজ্ঞতাও এই ধরনের আচরণের কারণ হতে পারে।

সঙ্গী কর্তৃত্বপরায়ণ হলে কী করবেন

আপনার সঙ্গীর মধ্যে যদি অতিরিক্ত কর্তৃত্বপরায়ণ আচরণ দেখা যায় তাহলে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে সমস্যাটির সমাধান করা উচিত। কর্তৃত্ববাদী সঙ্গীর সব কথা মেনে না নিয়ে নিজের মনকে প্রাধান্য দিতে হবে। তা না হলে জীবনে বিষণ্নতা বা অনিরাপত্তা বোধ চলে আসে। কর্তৃত্বের ব্যাপারটা যে ভালো লাগেনি, স্পষ্টভাবে এটা বুঝিয়ে বলতে হবে সঙ্গীকে।

এটা বলার জন্য সুসম্পর্কের সময়টা বেছে নেওয়া যেতে পারে। তবে কোনোভাবেই উত্তেজিত হওয়া যাবে না, সেটা হলে সংঘাত অনিবার্য।

বিষয়টি পছন্দ হচ্ছে না জানানোর পরও আপনার সঙ্গীর আচরণ যদি না বদলায়, তবে সম্পর্ক থেকে সরে আসাই শ্রেয়। তা না হলে ভবিষ্যতে ভুগতে হবে আপনাকেই।

যদি বুঝতে পারেন আপনিই কর্তৃত্বপরায়ণ সঙ্গী

আমরা অনেক সময় নিজেদের আচরণ বুঝতে পারি না। এমনকি নিজের আচরণ যে নিজেরই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সেটিও কখনো কখনো বুঝতে পারি না। আপনি যদি বুঝতে পারেন বা আপনার সঙ্গী যদি অভিযোগ করেন আপনি তার জীবন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন ও তার সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে থাকেন, তাহলে এ পরামর্শগুলো আপনার জন্য।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতিটি সম্পর্কে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকে, যা প্রত্যেকেরই মূল্যায়ন করা উচিত। ভালোলাগা বা মন্দলাগার অনুভূতি প্রকাশে আসলে বাধা নেই। তবে তা সঙ্গী কীভাবে নেবেন, সে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত।

মনে রাখতে হবে, সম্মান করা ও ধরে রাখা একটি সম্পর্কের প্রথম শর্ত। সম্পর্কে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের ফলে স্বতঃস্ফূর্ত বিষয়টি হারিয়ে যায়। মন রক্ষার তাগিদে আপনার সঙ্গী হয়তো আপনার এসব আচরণ মেনে নেন, কিন্তু আপনার প্রতি তার সম্মানের জায়গাটা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে। একসময় সেই  সস্পর্ক ভেঙে যেতে পারে।

তাই সঙ্গীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। যদি সঙ্গীর সঙ্গে মতভেদ দেখা যায় তবে দুজনে মিলে সরাসরি কথা বলা উচিত। যদি মনে হয় এই আচরণ আপনার সম্পর্কে খুব বেশি প্রভাব ফেলছে এবং দুজন কথা বলে কাটিয়ে উঠতে পারছেন না তবে একজন কাপল কাউন্সিলিং বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে পারেন।

 

Comments