মাতৃত্বকালীন ছুটির পর চাকরিতে ফেরা
'ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির পর প্রথম যেদিন অফিসে যোগ দিয়েছি, মনে হয়েছে বাচ্চাকে ফেলে আমার পক্ষে অফিসে থাকা সম্ভব না। অনেকটা নিজের মনের সঙ্গে সংগ্রাম করেই জয়েন করি। বাচ্চাটাকে রেখে আসতে খুব মন খারাপ হতো। আবার অন্যদিকে, যখন মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে প্রথম অফিসে ঢুকি, আমার কাছে মনে হয়েছে প্রথম থেকে আবার সব কাজ শুরু করতে হবে। নিজের সেই কর্মপরিবেশ আবার ফিরে পাওয়া একটু কঠিনই ছিল আমার কাছে।'
মাতৃত্বকালীন ছুটির পর কাজে ফেরার অভিজ্ঞতা বলছিলেন সানজিদা উর্মি। পেশায় সরকারি কর্মকর্তা তিনি।
বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফাহমিদা বর্ষা চার মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছিলেন। কিন্তু ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন তখনই চাকরিতে ফিরবেন কি না। আরও এক মাস ছুটি বাড়িয়ে নেন পরে। তারপর ফিরে যান কর্মক্ষেত্রে। কেয়ার গিভারসহ বাচ্চাকে রেখে যান মায়ের বাসায়। তাই কিছুটা চিন্তামুক্ত থাকেন তিনি।
ফাহমিদা বর্ষা বলেন, 'লম্বা একটা সময় অফিসেই চলে যায়। বিকেলে ফিরে যতটুকু সু্যোগ পাই বাচ্চাটাকে সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। তারপরও মনে হচ্ছে বাচ্চাটা বড় হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মিস করে যাচ্ছে অনেক কিছু। বাচ্চা প্রথম প্রথম খুব কান্নাকাটি করলেও এখন মানিয়ে নিয়েছে বেশ ভালোভাবেই।'
কলেজের অধ্যাপক লুৎফুন্নেছা। তিন সন্তানকে মানুষ করেছেন চাকরি করতে করতেই।
তিনি বলেন, 'বাচ্চাদের রেখে যখন কর্মক্ষেত্রে প্রথম দিকে যেতাম সবকিছু নতুন লাগত, মনও খারাপ হতো। বাচ্চাদের বাসায় রেখে আসায় দুশ্চিন্তা হতো সবসময়ই। গ্রামের দূর সম্পর্কের আত্মীয়কে এনেছিলাম বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে। তবে সহকর্মীরাও বেশ সাহায্য করতেন মানিয়ে নিতে। শিক্ষকতায় থাকার কারণে অতটা সময়ও দেওয়া লাগত না।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার সন্তানরা এখন বড় হয়ে গেছে। তারা এখন আমার ভালো বন্ধু। চাকরির ব্যাপারে তারাই আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়েছে। আমি সেসময় সব বাধার মুখে চাকরি করে গেছি বলে আজকে এই অবস্থানে আসতে পেরেছি। সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নারীদের চাকরিজীবনকে অনেক সহজ করে দিতে পারে।'
একজন নারী যখন মা হন তখন তার জীবনে আসে পরিবর্তন। তার জীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে ওঠে সন্তান। তিনি সবসময় মানসিকভাবে তার সন্তানকে ধারণ করতে থাকেন। সন্তানকে রেখে তাই মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষ কাজে ফেরা বেশ কঠিনই বটে।
এই কঠিন পরিস্থিতিতে কীভাবে মানসিক শক্তি কাজে লাগিয়ে কাজে ফিরবেন তা নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. মাহবুব আজাদ।
কীভাবে ফিরবেন কাজে
মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে কাজে ফেরার পর গ্রাস করতে পারে মন খারাপ, অনিচ্ছা আর আলসেমি।
ডা. মাহাবুব আজাদ বলেন, সন্তানকে রেখে কাজে গেলেই কেউ 'খারাপ মা' হয়ে যান এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে। আপনার শিশু জন্মানোর আগেই এমন একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ঠিক করে রাখুন, যিনি বা যারা আপনার অনুপস্থিতিতে আপনার সন্তানকে দেখবে। বর্তমানে বেশকিছু নির্ভরযোগ্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র বা ডে কেয়ার রয়েছে। পরিচিতদের মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
কর্মজীবী মা মনে করেন, লম্বা সময় বিরতিতে হয়তো পিছিয়ে গেছেন। তাই কাজ করে নিজেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন এবং অতিরিক্ত কাজের চাপ নিয়ে ফেলেন। তাড়াহুড়ো না করে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিন। আপনার বসের সঙ্গে কথা বলুন। সন্তানের জরুরি প্রয়োজনে যেন ছুটি নিতে পারেন, সেটিও বলে রাখুন।
আপনার সঙ্গীর সঙ্গে কাজ ভাগাভাগি করে নিন। আপনি যেমন মা হয়েছেন, তিনি হয়েছেন বাবা। তাই সন্তানের কাজগুলো একসঙ্গে করুন, একসঙ্গে সময় কাটান। আসলে মায়ের চাকরি সপ্তাহে ৭ দিন আর দিনে ২৪ ঘণ্টা, তা তিনি গৃহিণীই হোন বা চাকরিজীবী। আর নতুন মা হলে তো কথাই নেই। সারাদিন অফিসের কাজ করে তারপর বাসায় এসে বাচ্চার দেখাশোনা করতে গিয়ে নিজের প্রতি খেয়াল রাখার সময়ই হয় না। এ সময় অনেক মায়েরাই বিষণ্ণতায় ভোগেন। তাই নিজেকে সময় দিন ও নিজের যত্ন নিন।
মায়ের দিকে বাড়িয়ে দিন সাহায্যের হাত
প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পথ চলতে হয় একজন কর্মজীবী নারীকে।
ডা. মাহবুব আজাদ বলেন, এমনিতেই মা হওয়ার পরে প্রত্যেক নারীর মধ্যে সাময়িক বিষণ্ণতা কাজ করে। অনেক সময় সেটি স্থায়ী হতে পারে লম্বা সময়। বাচ্চা ধারণ, জন্মদান শেষে আবার আগের মত শুরু করা তার জন্য বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য পরিবারের মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, আপনার পরিবারে যদি কর্মজীবী মা থাকেন, তাকে সে সময় সাহস দেওয়া প্রয়োজন। একে তো বাচ্চাকে ছেড়ে দীর্ঘ সময় অফিসে দিতে হয় বলে মায়ের মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ জন্ম নেয়, এরপরে যদি পরিবারে এসে শোনেন সন্তান মাকে না পেয়ে কেঁদেছে বা খুঁজেছে তাহলে মা বিষণ্ণতায় ভুগতে পারেন। তাই স্বামীর কর্তব্য হবে সাধ্যমত সহায়তা করা।
মনে রাখতে হবে, কর্মজীবী মায়ের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় তার সঙ্গীর সহায়তা। দুজনে মিলে সংসার ও বাচ্চার কাজগুলো ভাগ করে নিলে চাপ কমে। অফিসের সহকর্মী যদি মা হন তবে দায়িত্ব রয়েছে আপনারও। তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন।
একটু সহযোগিতার অভাবে অনেক কর্মজীবী মা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বাংলাদেশে এখনো নির্ভরযোগ্য শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র বা ডে কেয়ার অপ্রতুল।প্রতিষ্ঠানে যদি ডে কেয়ারের ব্যবস্থা করা যায় তবে একজন মায়ের জন্য চাকরিতে ফেরা অনেক সহজ হবে।
Comments