শামায়লার ৬৪ জেলা ভ্রমণের গল্প

দেশ ঘুরে জীবনকে দেখার দৃষ্টিটাই পাল্টে গেছে শামায়লার। জীবনের ছোট অপূর্ণতাগুলো আর তাকে আগের মতো স্পর্শ করে না।

করোনাকালে যখন কমবেশি সবারই জীবনযাত্রার ধরন কিংবা প্রতিদিনের রুটিন বদলে গেছে, তখন অনেকেরই আক্ষেপের শেষ ছিল না। তবে তার মাঝেও কেউ কেউ সময়টাকে একেবারে অন্যভাবে কাজে লাগিয়েছেন। তেমনই একজন শামায়লা আহসান।

'তোর কয়টা জেলা ঘোরা হয়েছে?' কয়েক বছর আগে এক বন্ধুর এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েই এক দারুণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন শামায়লা। পুরো দেশ ঘুরে দেখার সংকল্প করে ফেলেন তিনি। এখন শামায়লা বাংলাদেশের সবকটি জেলা ঘুরে দেখা মানুষদের একজন। 

শামায়লা বর্তমানে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণের বেশ কয়েক মাস পর যখন সবকিছু ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছিল, তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অনলাইনেই করতে হতো। আর ঘরে বসে ক্লাস করতে করতে বিরক্তি ধরে যায় তার। কী করবেন ভাবতে বসে মনে হলো, ক্লাস যখন অনলাইনেই করতে হচ্ছে, তাহলে তো ঢাকার বাইরে বসেই ক্লাস করা যায়! ব্যস, শুরু হলো শামায়লার বাংলাদেশ ভ্রমণ।

শুরুতে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার মতো যাবার জায়গা খুঁজছিলেন। সেই চিন্তা থেকে চলে যান কুমিল্লায়। সেখানে ময়নামতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওয়ার সিমেট্রি এসব দেখে ফেলেন। এরপর থেকে সুযোগ আর সঙ্গী পেলেই চলে যাওয়া শুরু করেন দেশের নানা প্রান্তে।

নওগাঁয় শামায়লা।

ডে ট্রিপে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা, কখনো ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে, আবার কখনো 'চেনা বড় আপু' নাসরিনকে পেয়েছেন সঙ্গী হিসেবে। তবে সবচেয়ে বেশি যে ২ বন্ধুকে ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন তারা হলেন মৃত্তিকা আর তারিন। তারিনের সঙ্গেই কুমিল্লা, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং দক্ষিণবঙ্গের আরও কিছু জেলা ঘুরে ফেলেন শামায়লা। এরপর তাদের সঙ্গে যোগ দেন মৃত্তিকা।

একসঙ্গে এই ৩ জনের দারুণ সব অভিজ্ঞতা আছে। যার কোনোটা বেশ রুদ্ধশ্বাসও। এই যেমন- তাদের কক্সবাজার ভ্রমণ। বেশ শীতে কক্সবাজারের উদ্দেশে বাসে করে রওনা হন ৩ বন্ধু। এরপর আবিষ্কার করেন, প্রত্যাশারও আগে ভোর ৪টায় বাস পৌঁছে গেছে কক্সবাজার! হিম শীতের রাতে বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা না করে তারা সিদ্ধান্ত নেন মেরিন ড্রাইভে তাদের ঠিক করে রাখা পড-হাউজেই চলে যাবেন। এরপরের জার্নিটা হাড়কাঁপানো ঠান্ডা আর ভয়ের। ঘুটঘুটে অন্ধকার মেরিন ড্রাইভে, যখন কোথাও কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই, একপাশে শুধুই সাগরের গর্জন, তখন ৩ বন্ধু সিএনজিচালিত অটোরিকশা চেপে অপেক্ষা করছেন কখন এই রাস্তা শেষ হবে! সেবার খুব সাহসের সঙ্গেই সবটা সামলে নিয়েছেন তারা।

অবশ্য কোনোকিছুকেই বাধা মনে করেন না তিনি। সমাজে অনেকেরই ধারণা, মেয়ে মাত্রই দুর্বল, সাহস নেই, বিপদে পড়লে অন্য কাউকেই এগিয়ে আসতে হবে উদ্ধার করতে, তাই ভ্রমণ করতে পারবে না। এই ধরনের কোনো কথাকেই মনে স্থান দেননি শামায়লা। তার মতে, এই বাধাগুলো মনে স্থান দিলেই তা চেপে বসতে থাকে। এই মানসিক বাধাগুলোকে উৎরে যাবার মতো সাহস মনে রাখলে, যেকোনো বাধাই তুচ্ছ করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

দেশের পথে পথে নানা রকম নতুন অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। সিলেটে যেমন একটা গন্তব্য খুঁজে পেতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল। স্থানীয়রা বলতে পারছিল না, আবার ম্যাপে দেখাচ্ছিল সামনে রাস্তা আছে অথচ সেদিকে কোনো রাস্তা নেই। পরে অনেক ঘুরে একে ওকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দেখা মেলে। আবার লালমনিরহাটে এক মসজিদের খোঁজে এগিয়ে গেছেন মাইলের পর মাইল, তবুও দেখা নেই মসজিদের। অবশেষে যখন দেখা মিলল, তখন আর আনন্দ দেখে কে!

বাগেরহাটে শামায়লা।

দেশ ঘুরে কোন এলাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সবচেয়ে ভালো লেগেছে তা জানতে চাইলে শামায়লা সবার আগে বলেন কুষ্টিয়ার কথা, লালনের কথা। এরপর কুষ্টিয়ার খুব কাছের ২ জেলা মেহেরপুর আর পাবনার কথাও উল্লেখ করেন তিনি। মেহেরপুরের মুজিবনগর মনুমেন্ট দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, পাবনায় সুচিত্রা সেনের স্মৃতি রক্ষার্থে স্থাপিত জাদুঘরটিও দেখেছেন। আর এই জেলায় এমন এক প্রাচীন মসজিদের খোঁজ পান, যা নিয়ে লোকশ্রুতি আছে যে, এক রাতের মাঝেই নাকি পুরো মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল!

অধিকাংশ জেলা নিয়ে তেমন কোনো নির্দিষ্ট প্ল্যান না থাকলেও কিছু জায়গার ব্যাপারে আগে থেকেই আগ্রহ ছিল। যেমন- চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলপনা গ্রাম, ছোট সোনা মসজিদ, নাটোরের রাজবাড়ি, ফরিদপুরে পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বাড়ি, যশোরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি। আবার কখনো কখনো এমন করে কিছু খুঁজতে গিয়েই আচমকা নতুন কোনো গন্তব্যের দেখাও পেয়ে গেছেন।

নেত্রকোণায় শামায়লা।

এই লালমনিরহাট ঘুরতে ঘুরতেই এক জায়গায় দেখেন কুড়িগ্রাম মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে। ব্যস, বাসে চেপে কুড়িগ্রাম চলে গেলেন। আবার অনেক জায়গার খোঁজ পেয়েছেন স্থানীয় রিকশাচালক বা অটোচালকের কাছ থেকেও। এই যেমন নড়াইলে এক অটোচালক তাদের নিয়ে যান ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার বাড়িতে।

তবে গন্তব্য যাই হোক, ভ্রমণটাকেই বেশি উপভোগ করেছেন তিনি। তার ভাষায়- 'গন্তব্যের চাইতেও যে জার্নিটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই কথা সবসময় বইয়েই পড়েছি। কিন্তু নিজে অভিজ্ঞতা পেয়ে বুঝেছি, এর থেকে সত্যি আর কিছুই হতে পারে না।'

অনেকেরই ধারণা, বাংলাদেশে দেখার বেশি কিছু নেই। শামায়লাও এক সময় এমনটাই ভাবতেন। তবে ভ্রমণে বেরিয়ে এই ভুল ভেঙেছে তার। ঐতিহ্য, ইতিহাস কিংবা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পুরো বাংলাদেশটাই যে সুন্দর তা ভ্রমণ করলেই যে কারো চোখে ধরা পড়বে। এতটুকু আয়তনের এক দেশেই যে প্রত্যেকটি জেলার মুখের ভাষা, খাবার, পোশাক, জীবনধারায় নানান বৈচিত্র্য সে ব্যাপারটি বেশ অবাক করেছে তাকে।

নীলফামারীতে শামায়লা।

উত্তরবঙ্গে গিয়ে যেমন দেখেছেন, সবাই সবাইকে এমনকি তাদেরকেও 'তুমি' সম্বোধন করছে, আবার বরিশালের এক প্রত্যন্ত গ্রামে তাদের সবাই বিদেশি ভাবছে, তাদের সঙ্গে ছবি তুলতে চাইছে এমনটাও হয়েছে। আবার যেকোনো জায়গায় গিয়ে খেতে বসেই টের পেয়েছেন, এখানে কোনো রান্নায় এমন কিছু ব্যবহার করা হয়, যেটা আর কোথাও হয় না, কিংবা তার উল্টোটা।

তবে দুটো ব্যাপারে পুরো দেশকেই একই রকম মনে হয়েছে শামায়লার। একটি হচ্ছে, প্রায় সবখানেই স্থানীয়রা তাদের দেখে অবাক হয়ে জানতে চেয়েছেন, কেন তারা এই এলাকায় ঘুরতে এসেছেন? এখানে দেখার এমন কীইবা আছে! এই ব্যাপারটি খুব অবাক করেছে মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া শামায়লাকে। আরেকটি ব্যাপার হলো, দেশজুড়ে মানুষের আন্তরিকতা। যেখানেই ঘুরেছেন, পথ চেনা থেকে শুরু করে যেকোনো দরকারেই পেয়েছেন আন্তরিক সহযোগিতা।

তবে কয়েকটি অপ্রীতিকর ঘটনারও মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। কোথাও বাসে এক ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিতে ফেলেছে। আবার, কিছু এলাকায় যখনই কোনো অটো বা সিএনজি চালিত অটোরিকশা ঠিক করতে গেছেন, তখনই অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে, যা ছিল বেশ অস্বস্তিকর। সুন্দর এই জেলাগুলোয় কিছু মানুষের এমন আচরণ খুব ব্যথিত করেছে তাকে। আর তাকে হতাশ করেছে দেশজুড়ে নানান প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন সংরক্ষণের বেহাল দশা। সংস্কারের নামে কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনায় বেমানান রং করা কিংবা রড-সিমেন্টের ব্যবহার লক্ষ করেছেন বিভিন্ন স্থানে।

এইবেলা মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কীভাবে সামলে উঠলেন পুরো দেশ ঘোরার খরচটুকু? ঘুরে দেখার খুঁটিনাটি আগে থেকে সব ঠিক না করলেও, ভ্রমণের বড় পরিকল্পনাগুলো বুঝেশুনেই করতেন। খরচ সামলে কীভাবে এত এত জায়গা ঘুরে দেখা যায়, সেই পন্থা খুব ভালো মতোই বের করেছিলেন তিনি। আরামের সঙ্গে কিছুটা আপস করে ঢাকা থেকে দূরের সব জেলায় গিয়েছেন নন-এসি বাসে। আবার সেখান থেকে আশেপাশের  জেলায় বা দর্শনীয় স্থানগুলো দেখতে চড়েছেন লোকাল বাসে।

খুব কাছেই কোনো গন্তব্য না হলে, পারতপক্ষে রিকশা বা অটোরিকশায় চড়েননি। শুধু কি যাতায়াত? থাকার ব্যাপারেও ছিলেন সচেতন। খুব বিলাসবহুল জায়গা এড়িয়ে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন অথচ খরচে কুলাবে এমন সব থাকার জায়গাই বেছে নিয়েছেন। এমনভাবেই ঘুরেছেন, যেন ৩-৪ দিনের একটি ট্রিপ ৬-৭ হাজার টাকার মাঝেই শেষ হয়ে যায়। আর সঞ্চয়ের অভ্যাস থাকায় এই বাজেটও নিজের মতো করে গুছিয়েছেন শামায়লা। একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে পার্টটাইম কাজের পাশাপাশি, কনটেন্ট রাইটিংও করতেন তিনি।

আলাপ যখন প্রায় শেষের পথে, শামায়লার কাছে জানতে চাওয়া হলো দ্য ডেইলি স্টারের পাঠকদের এমন কোন কোন জায়গায় ঘুরতে যেতে উৎসাহিত করবেন, যেখানে সচরাচর কেউ যায় না। তিনি জানালেন, যদি ঢাকা থেকে দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার ইচ্ছা থাকে তাহলে তার সেরা ৫ পছন্দ হলো ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নরসিংদী এবং নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও। আর একটু দূরে যেতে চাইলে সবার প্রথমেই বলেন কুষ্টিয়ার কথা, সেখানকার নদীবিধৌত হরিপুরের কথা।

এ ছাড়া, বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পাড়ের মনোরম দৃশ্য, মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুর, পরিপাটি পরিচ্ছন্ন শহর রাজশাহী এবং সেখানের ছবির মতো সুন্দর টি বাঁধের কথাও বললেন তিনি। এর বাইরে সিরাজগঞ্জের চায়না বাঁধ আর শেরপুরের কৃত্রিম রাবার বাগানের কথাও উল্লেখ করলেন। সেইসঙ্গে এটিও যোগ করলেন, এসব জায়গায় যাতায়াত বেশ সহজ।

তবে যারা ভ্রমণ করতে ভালোবাসেন তাদের প্রতি কিছু অনুরোধও করেছেন শামায়লা। যেখানেই যান না কেন, সবাই যাতে সেই অঞ্চলের মানুষ, প্রকৃতি ও প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হয় সেটাই প্রত্যাশা করেন তিনি। যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা কিংবা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার নিয়ে নষ্ট করার মতো বিষয়গুলোর প্রতিও তিনি সবাইকে সচেতন হতে অনুরোধ করেন।

দেশ ঘুরে জীবনকে দেখার দৃষ্টিটাই পাল্টে গেছে শামায়লার। জীবনের ছোট অপূর্ণতাগুলো আর তাকে আগের মতো স্পর্শ করে না। তিনি দেখেছেন শ্রীমঙ্গলের সেই চা শ্রমিককে, মাসে যার আয় মাত্র ২ হাজার টাকা। কিংবা কক্সবাজারের সেই জেলে যার ঘরে কোনো ছাদ নেই, বা গ্রামের সেই চাষি যার ঘরে গুড় ছাড়া কেবল চাল দিয়েই ভাপা পিঠা বানানো হয়। এসব কাছ থেকে দেখে জীবনকে নতুন করে বুঝতে শিখেছেন বলে তিনি ভ্রমণের কাছে কৃতজ্ঞ। এখন তার মনে হয়, বেঁচে থাকাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

Comments