প্রথম সোলো ট্যুর আর থাইল্যান্ডের সিলমের সন্ধ্যাগুলো

থাইল্যান্ড
ছবি: নাদিয়া রহমান

২০১৯ সালে আমার প্রথম দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। গন্তব্য ছিল থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকক, যেখানে সিলমে একটি সামাজিক বিজ্ঞানের কনফারেন্সে নিজের একটি গবেষণা উপস্থাপন করেছিলাম। ব্যস্ততার কারণে কেবল পাঁচ দিনের ছুটি পেয়েছিলাম।

যদিও এর মধ্যে তিন দিনই কনফারেন্সের আলোচনা, উপস্থাপনা এবং নানা মতবিনিময়ে কেটে গিয়েছিল। তারপরেও বাকিটা সময়ের পুরোটাই সিলম যতটা পেরেছি ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছি। আমার একেবারে প্রথম বিদেশযাত্রা, তাও আবার `সোলো ট্যুর'। তাই অভিজ্ঞতা হিসেবে এই শহরের স্মৃতিগুলো এখনও বেশ প্রাণবন্ত।

সিলম কিংবা ব্যাংককের ঘোরার জায়গা, স্ট্রিট ফুড নিয়ে আমরা সবাই হয়তো কম-বেশি জানি। তবে একজন মেয়ে হিসেবে এই শহরের সান্ধ্যকালীন এবং রাতে ঘোরার জন্য যে নিরাপদ পরিবেশ সেই বিষয়টা ভালোলাগার মতো। এই গ্রীষ্ম, আবার পরক্ষণেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টির আবহাওয়ার মাঝে কনফারেন্স শেষে বেরিয়েই চলে যেতাম সেখানকার সবচেয়ে পরিচিত দোকান সেভেন-ইলেভেনে। পূর্ব-পশ্চিম এশিয়ার সবচাইতে 'কনভেনিয়েন্ট সুপারশপ' এই সেভেন-ইলেভেন। কোনো পানীয় আর হালকা স্ন্যাক্স নিয়ে পায়ে হেঁটেই ফিরে আসতাম হোটেলে।

বিকেল শেষে সন্ধ্যা নেমে আসলে আমার হোটেলের গলিটি সরব হয়ে উঠত। দিনের বেলা এই পথে নানা রকমের ফল, খাবার বিক্রেতারা বসতেন। কিন্তু সন্ধ্যার পর থাকত এক ভিন্ন পরিবেশ। সন্ধ্যার পর থেকে মধ্য রাত নাগাদ গলির পাবগুলোয় বন্ধুমহলের হাসি-ঠাট্টা আর হই-হুল্লোড়। সঙ্গে সেই দেশের ভাষার নানান সুর, যা আমি না বুঝলেও প্রাণবন্ত লাগত বেশ।

স্বাভাবিকভাবেই নিজ দেশে রাতের শহর এবং সে সময়ে বাড়ির বাইরে বন্ধুদের নিয়ে কোথাও বসে আড্ডা, এমনটা হয়েছে খুব কম। মূল পার্থক্য ছিল, এক ধরনের নিরাপদ আর স্বাধীন পরিবেশ। মেয়েরা যখন রাতের সিলমে হাঁটছে, কেনাকাটা, নিজেদের দোকানপাট গোছানোয় ব্যস্ত, সেখানে তাদের প্রত্যেকের মধ্যে স্বকীয়তা আর এক ধরনের স্বাধীনতা দেখেছি, যা অনেক জায়গায়ই অপ্রতুল।

সিলম শহরটির আর্কিটেকচার, শহরের লম্বা লম্বা গাছ, আর রাস্তায় মানুষের হাঁটাহাঁটি—সব কিছুই যেন ব্যস্ত জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য অবসর দেওয়ার একটি পথ ছিল। বিকেল নাগাদ যখন কনফারেন্সের কাজ শেষ হতো, তখন সিলমের রাস্তায় হাঁটতে বের হতাম। ঠান্ডা হাওয়া আর শহরের আলো, এই পরিবেশটা ছিল স্বস্তির। সঙ্গী হিসেবে মিলে গিয়েছিল সেই কনফারেন্সে পরিচয় হওয়া শ্রীলঙ্কার একজন বন্ধু। বন্ধুটির সঙ্গে সিলমের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, সন্ধ্যার স্ট্রিট ফুড উপভোগ করা, হিসেব করে খরচা সব কিছুই সেই ভ্রমণের স্মৃতিগুলোকে আরও বেশি রঙিন করে তুলেছিল।

রাতে কোনো রেস্তোরাঁয় খাবার সময়ে আমাদের কথোপকথনে চলে আসত দেশ, সংস্কৃতি, আর আমাদের নিজ নিজ গবেষণা। দুই ভিন্ন দেশের মানুষ হয়েও আমাদের অনুভূতিগুলো ছিল একেবারে কাছাকাছি। আমাদের এই আলোচনা, শহরের পথে ঘুরে বেড়ানো চলত মাঝ রাতেও । বাইরে হয়তো তখন ঝুম বৃষ্টি। যেহেতু আমাদের হোটেল থেকেই রেস্তোরাঁগুলো ছিল খুব কাছে, তাই মধ্যরাতে আমাদের দেশ, রাজনীতি, পছন্দের খাবার, নানান হিসেববিহীন আলোচনা শেষে ধীরেসুস্থে হেঁটে পৌঁছে যেতাম।

সবকিছু মিলিয়ে ফিরে আসবার বেলায় খারাপ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ফিরে গিয়ে সেই তো আবার পড়ানো এবং নিজের পড়াশোনা। ক্ষণিকের এই বন্ধু মানুষটির সঙ্গেও আর কবে কোথায় দেখা হয়! আসলে আর হয়ওনি। আগামী কোনো কনফারেন্সে দেখা করার পরিকল্পনা করলেও কোভিডের প্রকোপে দীর্ঘ সময় সবকিছু বন্ধও রইল। এরপর সব ঠিক হতেই আমি পড়তে চলে গেলাম যুক্তরাষ্ট্রে। এখনও যখন পাঁচ বছর আগেকার সিলমে মাত্র পাঁচটি দিনের কথা মনে করি, মনে হয় সময়টা ছিল নিজেকে সব দাপ্তরিক কাজ, হিসেবনিকেশ থেকে কিছুটা মানসিক স্বস্তির। আমি আর আমার শ্রীলঙ্কার সেই ক্ষণিকের সঙ্গী দুজনই শিক্ষক, তাই হয়তো শ্রেণিকক্ষের ভারিক্কি পরিবেশের বাইরে এই আড্ডা আমাদের জন্য দরকার ছিল।

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English

'Why should an innocent person be punished?' says Jahangir on Hamid's arrival

The home adviser says Hamid will face legal consequences only if an investigation finds him guilty

4h ago