একদিনে ঘুরতে পারেন মহাস্থানগড়ের যেসব দর্শনীয় স্থান

মহাস্থানগড়
ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

বগুড়ার শিবগঞ্জে অবস্থিত মহাস্থানগড় এক সমৃদ্ধ নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল। এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান।

একদিনের ছুটিতেই দেখতে পারেন মহাস্থানগড়ের সবকটি দর্শনীয় স্থান।

গোকুল মেধ বা বেহুলার বাসর ঘর

মহাস্থানগড়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান হলো গোকুল মেধ। স্থানীয়ভাবে এটাকে বেহুলার বাসর ঘর বলে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা ও হিউয়েন সাং তাদের ভ্রমণ কাহিনীতে এটিকে একটি বৌদ্ধ মঠ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার কিছু ঐতিহাসিক গ্রন্থে এটিকে একটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানীকে বাইরের শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য নির্মিত হয়েছিল।

বগুড়া
ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

এতে ১৭২টি ত্রিকোণ কক্ষ রয়েছে, যার এলোমেলো নির্মাণশৈলী এর রহস্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এটি বাসর ঘর না হলেও এর পশ্চিম অংশে বাসর ঘরের প্রবাদসংক্রান্ত স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। এর পূর্ব অংশে রয়েছে ২৪ কোণা বিশিষ্ট চৌবাচ্চার মতো একটি স্নানাগার, যার মধ্যে ৮ ফুট গভীর একটি কূপ ছিল।

মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড থেকে এর দুরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। জনপ্রতি ৩০ টাকা আটোরিকশা ভাড়ায় যাওয়া যায় এখানে। এ ছাড়াও এক থেকে দেড়শো টাকায় অটোরিকশা রিজার্ভ নিয়েও যাওয়া যায়। তবে বগুড়া থেকে মহাস্থানগড়ে আসলে সবার আগে এই দর্শনীয় স্থানটি পড়বে।

মাহী সওয়ার মাজার শরীফ

মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড থেকে কিছুটা পশ্চিমে মাহী সওয়ার মাজার শরীফ অবস্থিত। বাসস্ট্যান্ড থেকে পায়ে হেঁটেই মাত্র দুই মিনিটে এখানে আসা যায়। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই মাজারে আসেন। প্রতি বছরের বৈশাখ মাসের শেষ তারিখে এখানে শেষ বৈশাখী মেলা হয়।

জিয়ৎ কুণ্ড

মাহী সওয়ার মাজার শরীফ দর্শন শেষে পায়ে হেঁটে দুই থেকে তিন মিনিটেই যাওয়া যায় জিয়ৎ কুণ্ডে। এটি এক ঐতিহাসিক কুয়া।

ইতিহাসবিদদের ধারণা, এটি রাজা পরশুরামের শাসনামলে খনন করা হয়েছিল, সম্ভবত ১৮শ-১৯শতকের মাঝামাঝি সময়ে পরশুরাম প্রাসাদের নির্মাণের সময়। স্থানীয় জনগণের পানির অভাব মেটাতে কূপটি খননের উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে করা হয়।

পরশুরামের প্রাসাদ

জিয়ৎ কুণ্ড দেখে আসতে পারেন পরশুরামের প্রাসাদে। এটি মহাস্থানগড়ের সীমানা প্রাচীরের ভিতরে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। স্থানীয়ভাবে এটিকে 'হিন্দু নৃপতি পশুরামের প্যালেস' বলা হয়। ১৯০৭, ১৯৬১ এবং ১৯৯৫ সালে তিনবার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজের মাধ্যমে তিনটি আলাদা নির্মাণ যুগের সন্ধান পাওয়া যায়। সুলতানি আমলের ইমারতের নিচে প্রথম পর্যায়ের ভবনের ধ্বংসাবশেষ এবং পাল আমলের পোড়ামাটির চিত্রফলক পাওয়া যায়।

উপরের স্তরে আবাসবাটির একটি বিশাল নকশা উন্মোচিত হয়েছে, যেখানে চারটি পৃথক মহলের অস্তিত্ব রয়েছে। প্রাসাদের প্রধান প্রবেশদ্বারের দুই পাশে প্রহরী কক্ষের নিদর্শন দেখা যায়। এটি অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে নির্মিত, যা মোঘল ও ব্রিটিশ আমলের নির্মাণশৈলী নির্দেশ করে।

গোবিন্দ ভিটা

জিয়ৎ কুণ্ডু দেখে বা মহাস্থান বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোরিকশা, টেম্পু অথবা পায়ে চালিত ভ্যানযোগে মাত্র ১০ মিনিটে আসতে পারবেন গোবিন্দ ভিটায়।

করতোয়া নদীর তীরে মহাস্থান দুর্গের নিকটে অবস্থিত একটি প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান গোবিন্দ ভিটা। ১৯২৮-২৯ সালে খননকালে এখানে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়, যা খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়।

গোবিন্দ ভিটা নামটি হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর আবাস নির্দেশ করে, কিন্তু এখানে বৈষ্ণব ধর্মের কোনও নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এই স্থানে আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তুগুলোর মধ্যে রয়েছে তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রা, কালো চকচকে মৃৎপাত্রের টুকরা এবং পোড়ামাটির ফলক।

মহাস্থানগড় জাদুঘর

গোবিন্দ ভিটার একদম সামনেই মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর। জাদুঘরটি ১৯৬৭ সালে করতোয়া নদীর তীরে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মহাস্থানগড়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে।

জাদুঘরে মৌর্য, গুপ্ত ও পাল রাজবংশের প্রাচীন নিদর্শনসহ সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জ, পোড়ামাটির মূর্তি এবং অলংকার সংরক্ষিত রয়েছে। উল্লেখযোগ্য নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের পোড়ামাটির মূর্তি, ১৫০০ শতকের আরবি শিলালিপি এবং বিভিন্ন শতকের ব্রোঞ্জের মূর্তি।

এ ছাড়াও এটিকে উত্তরাঞ্চলের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত করা হয়। রোব ও সোমবার সকালে জাদুঘরটি বন্ধ থাকে এবং প্রতিদিন সাড়ে ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতি।

সবশেষে জাদুঘর দেখে মহাস্থান ভ্রমণ শেষ করতে পারেন। হাতে সময় থাকলে এগুলোর পাশাপাশি আরও দেখতে পারেন, শীলা দেবীর ঘাট, কালীদহ সাগর, বৈরাগীর ভিটা, খোদার পাথর ভিটা, ভীমের জঙ্গলসহ আরও বেশ কয়েকটি স্থান।

তবে মহাস্থান ঘোরা শেষে এখানকার বিখ্যাত চালের কটকটি খেতে এবং পরিবারের জন্য নিতে ভুলবেন না।

ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন

গাবতলী বা মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সরাসরি বাসে এবং কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে করে প্রথমেই বগুড়া যেতে হবে। বাসে এসি নন-এসিভেদে ৮০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা ভাড়া। ট্রেনে আন্তনগর রংপুর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস বা লালমনি এক্সপ্রেসে যাওয়া যায়। এসি নন-এসিভেদে ভাড়া ৪৭৫ টাকা থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা।

এরপর বগুড়া থেকে অটোরিকশা বা বাসে ৩০ মিনিটে সরাসরি যাওয়া যায় মহাস্থান বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে সব দর্শনীয় স্থান ঘুরার জন্য অটোরিকশা বা ভ্যান রিজার্ভ পাওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা ভাড়া গুনতে হতে পারে। তবে দুই- একটা জায়গা ছাড়া পায়ে হেঁটেই সব দর্শনীয় স্থান দেখা ভালো।

যেখানে থাকবেন

মহাস্থানগড়ে থাকার মতো তেমন ভালো হোটেল নেই। ৩০ মিনিট দূরত্বে বগুড়ায় থাকতে পারবেন হোটেল মম ইন (ফাইভ স্টার মানের), হোটেল নাজ গার্ডেন (ফোর স্টার মানের), পর্যটন মোটেল (বনানী মোড়ে), নর্থওয়ে মোটেল (কলোনী বাজার) ইত্যাদি জায়গায়। এগুলো প্রত্যেকটাই শহরের নিরিবিলি পরিবেশে। এসব হোটেলে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকায় থাকা যায়।

যা খাবেন

বগুড়ায় আকবরিয়া বা শ্যামলী হোটেলে খেতে পারেন। এ ছাড়াও আকবরিয়ার দই, এশিয়ার দই ও মিষ্টি, চিনিপাতার দই ও চুন্নুর গরুর চাপ খেতে পারেন।

 

Comments