দেশের এই ৭ দৃষ্টিনন্দন মসজিদ দেখেছেন কি

মসজিদ
জেবুন নিসা মসজিদ। ছবি: আসিফ সালমান

আপনি যদি ইতিহাসপ্রেমী হন কিংবা ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি আপনার আগ্রহ থাকে, অথবা যদি হন কেবলই একজন পর্যটক তাহলেও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মসজিদগুলো আপনাকে দিতে পারে দারুণ অভিজ্ঞতা। কারুকাজ, নান্দনিকতা এবং নির্মল পরিবেশের পাশাপাশি কিছু কিছু স্থাপনা তো রীতিমতো আপনাকে হতবাক করে দেবে।

আমরা এখানে তুলে ধরছি দেশের অসাধারণ মসজিদগুলোর একটি তালিকা, যেগুলো ঘুরে দেখতে পারেন।

 

আমান মসজিদ, নারায়ণগঞ্জ

ব্যস্ত নারায়ণগঞ্জের বুকে এই মসজিদের অবস্থান। এটা এমন একটি স্থান যা মনকে দারুণ প্রশান্তি দেয়। মসজিদের প্রাঙ্গণটি ঢালু দেয়াল পরিবেষ্টিত, যা অনেকটা ডুবন্ত উঠানের পরিবেশ তৈরি করে। এমন একটি পবিত্র স্থানের কথা কল্পনা করুন, যেটা অনেকটা ভূগর্ভস্থ স্থানের মতো। যেখানে হাঁটলে আমি চারপাশের ব্যস্ত জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন।

নকশাবিদ আর্কিটেক্টসের নকশায় ২০১৮ সালে তৈরি করা হয় মসজিদটি। তখন থেকেই এটি স্থানীয় সব শ্রেণির মানুষের কাছে পছন্দের জায়গায় পরিণত হয়েছে।

ওপর থেকে দেখতে মসজিদের নামাজ কক্ষটি ঘনাকৃতির, পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ মিনারটি দূর থেকে সৃষ্টি করে এক মনোরম দৃশ্যের। এর দেয়ালজুড়ে ত্রিকোণাকার জালের মতো নকশা, যা দিয়ে নামাজকক্ষে প্রবেশ করে সূর্যের আলো এবং বাতাস। বিশেষ আকৃতির কারণে মসজিদের ভেতর খেলা করে আলো-ছায়ার দারুণ এক দৃশ্য।

আপনি যদি এই জাদুকরী পরিবেশে কিছু সময়ের জন্য ডুবে যেতে চান, তাহলে পরবর্তী ভ্রমণ গন্তব্য হিসেবে নারায়ণগঞ্জের আমান মসজিদকে রাখতে ভুলবেন না যেন!

স্থাপত্য
ছবি: আসিফ সালমান

বাইত-উর-রাইয়ান মসজিদ, মাদারীপুর

গ্রামীণ বাংলাদেশের বুকে যদি আপনারা একটি আধুনিক মসজিদ দেখতে চান, তাহলে যেতে হবে মাদারীপুরের বাইত-উর-রাইয়ান মসজিদে। দৃষ্টিনন্দন একতলা মসজিদটি কেবল নামাজের ঘর থেকেও বেশি কিছু। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য একটি মিলনস্থল হিসেবে কাজ করে। তারা এখানে বিভিন্ন সময় একত্রিত হন এবং নানা ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন, জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় অংশ নেন।

সুবিশাল আড়িয়ল খাঁ নদীর ধারে অবস্থিত মসজিদটি লাল ইটের তৈরি, যা আশপাশের গ্রামীণ সৌন্দর্যকে যেন আরও বাড়িয়ে তোলে। এমনকি আপনি যদি কেবল মসজিদটির ছবি দেখলেও সেটির প্রতি এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করবেন। মসজিদের চারদিকে চারটি মিনার আর মাঝখানে ভাসমান সাদা রঙের গম্বুজ, এর সৌন্দর্যকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। নির্মাণশৈলীর কারণে সবসময়ই দিনের আলো প্রবেশ করে মসজিদটিতে।

অন্যান্য মসজিদ থেকে যা এটিকে আলাদা করে তা হলো এখানে নেই ভারী কোনো অলঙ্করণ। সাদাসিধে ও নূন্যতম নকশায় তৈরি হয়েছে এই মসজিদটি। ২০২৩ সালে কিউবইনসাইড ডিজাইন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নকশায় এই মসজিদটি তৈরি করা হয়। যা এরই মধ্যে পেয়েছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি যার মধ্যে রয়েছে মর্যাদাপূর্ণ আর্কিটেকচার মাস্টারপ্রাইজ পুরস্কার।

খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ, ঢাকা

ইতিহাসপ্রেমীরা, প্রস্তুত হোন নিজের মহিমায় উজ্জ্বল খান মোহাম্মদ মৃধা মসজিদ দেখে মুগ্ধ হওয়ার জন্য। এই রাজকীয় মসজিদটি দেখলে নিশ্চিতভাবে সেই সময়ে ফিরে যাবেন যখন শক্তিশালী মুঘল সাম্রাজ্যের নিদর্শন হিসেবে এটিকে তৈরি করা হয়েছিল।

মসজিদের রহস্যময় সিঁড়ি বেয়ে উঠলে আপনি পেয়ে যাবেন এক সুবিশাল স্থান, যেখানে সময় যেন থমকে আছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন এই মসজিদটির অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী দেখতে।

সৌন্দর্যভরা এই স্থাপনা দেখতে আপনাকে যেতে হবে পুরান ঢাকা। আর সেখানে গেলে এই মসজিদের পাশাপাশি দেখে আসতে পারেন মুঘল আমলের আরেক নিদর্শন লালবাগ কেল্লাও।

মিয়া বাড়ি মসজিদ, বরিশাল

বরিশালের কড়াপুরে অবস্থিত মিয়া বাড়ি মসজিদটি একটি অসাধারণ স্থান। ১৮ শতকে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটিও ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য আদর্শ জায়গা হতে পারে। জনশ্রুতি আছে, হায়াত মাহমুদ নামের একজন বিদ্রোহী জমিদার এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তাকে এক সময় বিদেশে নির্বাসিত করা হয়। পরে বাংলার মাটিতে ফিরে আসার পর তিনি নির্মাণ করেন অসাধারণ এই স্থাপনা।

মসজিদটির উভয় পাশে রয়েছে চারটি করে মিনার এবং রয়েছে তিনটি অলংকৃত গম্বুজ। মিনারগুলোতে রয়েছে ফুলেল নকশা আর জটিল কারুকাজ, যা রীতিমতো অবাক করে দেওয়ার মতো সুন্দর। এই স্থাপনা বাঙালি কারিগরদের নৈপুণ্যের এক অনন্য উদাহরণ, যা আজও গ্রামীণ পরিবেশে স্থাপিত মসজিদটিকে নান্দনিক করে তোলে।

কুসুম্বা মসজিদ, নওগাঁ

বাংলার কালো রত্ন নামে পরিচিত মসৃণ-কালো চেহারার নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ তুলনামূলক কম পরিচিত। এটি মূলত সুলতানি আমলের একটি নিদর্শন। ছয় গম্বুজ আর গোলাকার কোণবিশিষ্ট একশিলা কাঠামো মসজিদের স্থাপত্যশৈলিকে অনন্য করে তুলেছে। এর দেয়ালগুলো অসাধারণ শিল্পকর্মে সজ্জিত, যা একে করেছে আরও নান্দনিক।

বাংলার অন্যান্য মসজিদের সঙ্গে তুলনা করলে কুসুম্বা মসজিদের স্থাপত্য, নির্মাণশৈলি নিঃসন্দেহে নজরকাড়া। এর অনন্য শৈলির কারণে মুসুল্লিরা যেন গভীর আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে এখানে প্রার্থনা করতে পারেন। বেলেপাথর, গ্রানাইট ও মার্বেল পাথরে তৈরি এই স্থাপনাটি সুলতানি আমলের রাজকীয়তার এক জাদুকরী নিদর্শন।

মেয়র মোহাম্মদ হানিফ জামে মসজিদ, আজিমপুর, ঢাকা

ঐতিহাসিক আজিমপুর এলাকায় অবস্থিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ জামে মসজিদটি একটি অত্যাধুনিক স্থাপনা।

মসজিদটিতে প্রবেশ করলেই এর প্রশস্ত বারান্দা আপনাকে স্বাগত জানাবে, ব্যস্ত নগরজীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য দেবে শান্তি। এর সুউচ্চ মিনার আর পাশেই আজিমপুর কবরস্থানের শান্ত দৃশ্য কিছু সময়ের জন্য আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য দুনিয়ায়। যেখানে দাঁড়িয়ে আপনি ভাববেন কোনও এক অদেখা শক্তির কথা, নিজের ক্ষুদ্র জীবনের কথা।

মসজিদটির নকশা করেছে সাতত্য আর্কিটেকচার। এখানে রয়েছে নারীদের নামাজের জন্য আলাদা হলঘর, যেখানে সরাসরি রোদ এসে পড়ে ছাদের বৃত্তাকার স্থানের মধ্য দিয়ে।

জেবুন নিসা মসজিদ, আশুলিয়া

বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ২০২৫ সালের বিশ্বের সেরা স্থানগুলোর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে সাভার আশুলিয়ার জেবুন নিসা মসজিদ। স্টুডিও মরফোজেনেসিস লিমিটেডের নকশা করা এই স্থাপনাটিকে বাংলাদেশের আধুনিক মসজিদগুলোর প্রতীক বলা যেতে পারে। মসজিদ প্রাঙ্গণে পৌঁছলে আপনাকে স্বাগত জানাবে গোলাপি রঙের মসজিদের বাঁকা দেয়াল, যা দেখে আপনি মুগ্ধ হতে বাধ্য।

জেবুন নিসা মসজিদ
ছবি: আসিফ সালমান

এক শিল্পপতির মায়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তৈরি করা হয়েছিল মসজিদটি। পুরো প্রাঙ্গণটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেন কারখানার কর্মীরা আনন্দের সঙ্গে, প্রশান্তির সঙ্গে প্রার্থনা করতে পারেন। আবার এটি সামাজিক মিলনস্থল হিসেবেও কাজ করে যেখানে যে কেউ চাইলে বিশ্রাম নিতে পারেন, নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারেন।

এই মসজিদের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো, যখন আপনি পশ্চিম দিকে তাকাবেন তখন খিলানযুক্ত খোলা অংশ দিয়ে চোখে পড়বে শান্ত জলরাশি। মুসুল্লিরা যখন প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন তখন ঝিঁকমিক করে স্বচ্ছ কাচের মিরাব।

চমৎকার এই স্থাপনাটি টাইম ম্যাগাজিনের তালিকায় একমাত্র নাম হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। তাই এটি দেখার সুযোগ হারাবেন না। সুযোগ পেলে অবশ্যই ঘুরে আসুন জেবুন নিসা মসজিদ।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

 

Comments

The Daily Star  | English

Yunus meets Chinese ambassador to review China visit, outline next steps

Both sides expressed a shared commitment to transforming discussions into actionable projects across a range of sectors

7h ago