প্রসব পরবর্তী ৩ ধরনের মানসিক সমস্যা, করণীয় কী
পৃথিবীতে একটি শিশু আগমনের পর সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে নবাগত সদস্যকে নিয়ে। কিন্তু নতুন মায়ের যে বিশেষ যত্নের প্রয়োজন সেটা অনেকেই বুঝতে পারেন না।
গর্ভাবস্থা ও পরবর্তী বেশ কিছুদিন একজন নারীর জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমরা বাইরে থেকে একজন মায়ের দেহের বাহ্যিক পরিবর্তনটাকেই দেখি, কিন্তু ভেতরকার পরিবর্তন অন্তরালেই থেকে যায়। এই সময়টায় শুধু শারীরিক পরিবর্তন নয়, হরমোনের কারণে মানসিক পরিবর্তনও আসে।
প্রসবোত্তর সময়টা অনেক নারীর ক্ষেত্রে নাজুক হয়ে ওঠে। এই সময় হরমোনের পরিবর্তন একজন মাকে বিভিন্ন মাত্রায় প্রভাবিত করে, নতুন মা নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। দৈনন্দিন জীবনের ছন্দে পরিবর্তন, সন্তানের যত্ন, রাত জাগা সবকিছু মিলিয়ে মা বেশ হাঁপিয়ে ওঠেন। প্রসব-পরবর্তী এই পরিবর্তন স্বাভাবিক। সব মায়ের মধ্যেই কম-বেশি প্রভাব দেখা যায়,তবে সবার ক্ষেত্রে যে প্রভাব সমান তা নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মায়ের ওপর এমন প্রভাব পড়ে, যার জন্য চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন হয়।
সন্তান জন্মদানের পর একজন মায়ের মধ্যে কী কী মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে এবং সেক্ষেত্রে কী করণীয় তা নিয়েপরামর্শ দিয়েছেন লাইফ স্প্রিংয়ের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সিমুন নিসা।
সিমুন নিসা বলেন, 'একজন সদ্য মায়ের মধ্যে তিন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেগুলো হল পোস্ট পার্টাম ব্লুজ, পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন এবং পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস। বাচ্চা জন্মদানের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে এক বছরের মধ্যে এই সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এই সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করে।'
পোস্ট পার্টাম ব্লুজ
পোস্ট পার্টাম ব্লুজকে 'বেবি ব্লুজ'ও বলা হয়। প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ মা এই পোস্ট পার্টাম বলুজের মুখোমুখি হন। শিশুর জন্মের দুই-একদিনের মধ্যেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে। হরমোনের প্রভাবে মা হয়তো এই হাসিখুশি, আবার খানিকবাদেই চোখ ফেটে কান্না আসতে পারে। আবার একটু পরে হয়তো মনের কোণে জন্ম নেয় রাগ। অনেকেই হয়তো শিশুকে নিয়ে অযথাই দুশ্চিন্তা করেন।
এই লক্ষণগুলো বড়জোর দুই সপ্তাহ স্থায়ী হয় এবং শরীরে হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক হলে লক্ষণগুলো ক্ষীণ হতে শুরু করে এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
করণীয়: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সিমুন নিসা বলেন, যেহেতু হরমোনের পরিবর্তনের কারণে বেবি ব্লুজ হয় তাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য তেমন কোনো ওষুধ বা কাউন্সেলিং প্রয়োজন নেই। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সহানুভূতিশীল আচরণই যথেষ্ট।
পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন
পোস্ট পার্টাম ব্লুজের দীর্ঘস্থায়ী রূপটি হলো 'পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন'। সন্তান জন্মের দু-এক মাসের থেকে শুরু করে এক বছরের মধ্যে এই লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে। এর সঙ্গে পোস্ট পার্টাম ব্লুজের বেশ মিল রয়েছে। তবে এই লক্ষণের পাশাপাশি তিনি নিজেকে একজন ব্যর্থ মা মনে করতে থাকেন এবং গভীর অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন।
মায়ের মাঝে তীব্র হতাশা, ব্যক্তিগত যত্নে অনীহা, দৈনন্দিন দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছা, কারণ ছাড়া কান্নাকাটি, মন খারাপ এই লক্ষণগুলো দেখা যায়। এই সমস্যা তীব্র আকার ধারণ করলে অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়, অনেক সময় পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের কারণে মা সমস্ত কিছুর জন্য শিশুকে দায়ী ভাবা শুরু করেন এবং শিশুর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে হিংস্র আচরণও ফেলতে পারেন।
করণীয়: পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ প্রকাশ পেলে এটিকে হেলাফেলা করার উপায় নেই, তখন অবশ্যই একজন মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তিনি প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং কাউন্সিলিংয়ের পরামর্শ দিবেন। চিকিৎসা ছাড়া মা ও শিশু উভয়ের ওপর দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব পরতে পারে।
পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস
পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায়। হাজারে একজন মায়ের মধ্যে এই মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর লক্ষণগুলো সাধারণত সন্তান জন্মদানের পর প্রথম কয়েক দিন বা সপ্তাহের মধ্যে আবির্ভূত হয়। তাছাড়া যে নারীদের বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা সিজো অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার রয়েছে তাদের পোস্ট পার্টাম সাইকোসিস হওয়ার আশঙ্কা বেশি। পোস্ট পার্টাম ব্লুজ বা পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণগুলো আমাদের সমাজে স্বাভাবিক মনে হলেও, পোস্ট পার্টাম সাইকোসিসের লক্ষণগুলো বেশ প্রকট। অস্বাভাবিক আচরণ ও কথাবার্তা, ভ্রম, অদৃশ্য কারো সঙ্গে কথা বলা, অকারণে হাসা, নিজে নিজে কথা বলা, একদম না ঘুমানো, শিশুকে ভয়ানক কিছু মনে করা ইত্যাদি সাইকোসিসের লক্ষণ।
করণীয়: এসব লক্ষণ কোনো মায়ের মধ্যে দেখা দিলে যত দ্রুত সম্ভব একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। এক্ষেত্রে ওষুধ এবং প্রয়োজনে কাউন্সিলিং করবেন। শুধু তাই নয়, পরিবারের সদস্যদেরও মা ও শিশুকে বিশেষ নজরদারিতে রাখতে হবে।
প্রসব-পরবর্তী মানসিক সমস্যায় মায়ের করণীয়
নতুন মা অনুভূতিগুলোকে নিজের মধ্যে না রেখে বিশ্বস্ত কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিতে পারেন, তখন মনে হবে আপনি একা নন। এই সময় একা না থেকে বরং পছন্দের মানুষগুলোর সঙ্গে বেশি বেশি সময় কাটাতে হবে। এক্ষেত্রে সন্তানের বাবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। নিজেকে সময় দিতে হবে, নিজের যত্ন নিতে হবে। সন্তান পালনের ফাঁকে নিজেকে সময় দিতে বসতে পারেন নিজের পছন্দের চায়ের কাপ নিয়ে। যদি কাজ বা চাকরির জন্য প্রস্তুত না হন, তবে নিজের ওপর জোর করা উচিত নয়। মনে রাখতে হবে এই সময়টা মা ও শিশুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন, রাতের ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি শিশু অনেকক্ষণ জেগে থাকে তাহলে অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে বিশ্রাম নিতে হবে। শিশুর যত্নের জন্য মায়ের যথেষ্ট বিশ্রাম প্রয়োজন।
কেমন হবে পারিবারিক ভূমিকা
পোস্ট পার্টাম ব্লুজ বা বেবি ব্লুজ, পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন ও পোস্ট পার্টাম সাইকোসিসের মধ্যে পার্থক্যগুলো সূক্ষ্ম। 'আমরাও তো মা হয়েছি' এ ধরনের যুক্তি দিয়ে এই সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। বরং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উচিত নতুন মায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল ও আন্তরিক হওয়া।
যেহেতু মা শারীরিক এবং মানসিক ধকলের মধ্য দিয়ে যান, তাই মাকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে হবে। শিশু পালনে মাকে দোষ না দেয়া, অহেতুক উপদেশ, সমালোচনা থেকে বিরত থাকা উচিত। শিশুর পাশাপাশি যে মাও গুরুত্বপূর্ণ আর বিশেষ একজন- এই বিশ্বাস তার মধ্যে তৈরি করতে পারলে এই ধরনের মানসিক সমস্যাগুলো এড়ানো সম্ভব। লক্ষণ প্রকাশ পেলে বিষয়টিকে হেলাফেলা না করে একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
Comments