লুপাসের কারণ ও লক্ষণ, গর্ভধারণে জটিলতার ঝুঁকি কতটা

লুপাস
ছবি: সংগৃহীত

লুপাস একটি অটোইমিউন রোগ। অটোইমিউন রোগ এমন একটি অবস্থা যখন নিজের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজের দেহের সুস্থ কোষ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিরুদ্ধে কাজ করে।

লুপাস সম্পর্কে জেনে নিন এনাম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের রিউমাটোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বিআরবি হসপিটালস লিমিটেডের রিউমাটোলজি অ্যান্ড মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. হাবিব ইমতিয়াজ আহমদের কাছ থেকে।

লুপাস কী

ডা. হাবিব ইমতিয়াজ বলেন, লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করলে লুপাস একটি মাল্টি সিস্টেম ডিজিজ, যা শরীরের কোষ ও বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রান্ত করতে পারে। ত্বক, চোখ, মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি, প্রজনন স্বাস্থ্যসহ এমন কিছু নেই, যা লুপাসে আক্রান্ত হয় না।

লুপাস কেন হয়

অটোইমিউন অন্যান্য রোগের মতোই লুপাস কেন হয় তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে লুপাস নারীদের বেশি হয়। লুপাস আক্রান্তের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় ৯ গুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকেন নারীরা।

জেনেটিক বা বংশগত কারণে লুপাস হতে পারে, পরিবেশগত বিভিন্ন কারণ, বায়ু দূষণ, ধূমপান, জন্ম বিরতিকরণ পিল খাওয়া, হরমোনজনিত প্রভাব, নির্দিষ্ট কিছু ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে লুপাস আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোষ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আক্রমণ করার ফলে প্রদাহ দেখা দেয় এবং অটোইমিউন ডিজিজ লুপাসে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।

লুপাসের লক্ষণ

লুপাস রোগের পুরো নাম হলো সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথ্রোমেটোসিস বা এসএলই। ল্যাটিন ভাষায় লুপাস অর্থ নেকড়ে। নেকড়ে আড়ালে থেকে সুযোগ বুঝে অনেকটা সময় নিয়ে যেভাবে শিকারের উপর ঝাপিয়ে পড়ে, লুপাস রোগটিও তাই।

অন্যান্য রোগে দেখা যায় এমন সাধারণ কিছু লক্ষণ বহন করে লুপাস। শরীরে দীর্ঘদিন ধরে থাকে সেই সব লক্ষণ। এরপর হঠাৎ করে দেখা যায় রোগীর কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গুরুতরভাবে আক্রান্ত, যা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

জ্বর, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া এ ধরনের লক্ষন দেখা যায় প্রাথমিকভাবে।

এরপর আরও কিছু লক্ষণ থাকে যেমন- জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা। তবে ব্যথা অনেক বেশি তীব্র হয় না। ত্বকে কিছু লক্ষণ দেখা যায়। যেমন- রোদে গেলে ত্বক জ্বালাপোড়া করা, ত্বকে লাল র‌্যাশ বা ফুঁসকুড়ির মত হওয়া, ঠান্ডা পানিতে হাত দিলে হাতের রং পরিবর্তন হওয়া, চুল পড়ে যাওয়া, মুখের ভেতর ঘা হওয়া। এগুলো মৃদু লুপাসের লক্ষণ। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এই লক্ষনগুলো।

এ ছাড়া লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে দেওয়া, কিডনির ছাকনিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে শরীর থেকে প্রোটিন বের করে দেওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস, ফুসফুসে পানি জমে যাওয়া, ফুসফুস শুকিয়ে যাওয়া, লিভারে সমস্যা, মস্তিষ্ক আক্রান্ত হলে খিঁচুনি, স্ট্রোকের মত লক্ষণ নিয়েও আসতে পারেন রোগী। এই ধরনের বিভিন্ন জটিল লক্ষন দেখা যায় লুপাস রোগীদের ভেতর।

শিশুদের কি লুপাস হয়?

ডা. হাবিব ইমতিয়াজ বলেন, শিশুরাও লুপাস আক্রান্ত হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে সিস্টেমিক উপসর্গ অর্থাৎ জ্বর, শরীর ম্যাজম্যাজ করা এবং ত্বক ও কিডনিজনিত জটিলতা বেশি হয়ে থাকে।

লুপাসে কি গর্ভধারণে জটিলতা হতে পারে?

লুপাস রোগে নারীরা বেশি আক্রান্ত হন। লুপাসের কারণে নারীদের গর্ভধারণ ও যৌন স্বাস্থ্যের জটিলতা দেখা দেয়। বার বার গর্ভপাত এবং গর্ভধারণে সমস্যা সৃষ্টি করে। গর্ভাবস্থায় লুপাস রোগের তীব্রতা অনেক সময় বেড়ে যায়, অনেক সময় একই রকম থাকে।

বিশেষ এক ধরনের লুপাস আছে যার নাম অ্যান্টিফসফোলিপিড সিন্ড্রোম। এটা উপরের লক্ষণগুলো ছাড়া আলাদাভাবেও হতে পারে, আবার একসঙ্গেও থাকতে পারে।

এক্ষেত্রে দেখা যায় আক্রান্ত নারী গর্ভধারণ করছেন কিন্তু ১০ সপ্তাহ পর বার বার গর্ভপাত হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া গর্ভজাত সন্তানের বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া, নির্ধারিত সময়ের আগে সন্তান প্রসব, সময়ের আগে পানি ভেঙে যাওয়ার মত জটিলতা দেখা দেয়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে গর্ভের সন্তান মারাও যেতে পারে।

রোগের তীব্রতা বেশি হলে গর্ভধারণের ক্ষমতা হ্রাস পায়। এ ছাড়া লুপাস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় গর্ভধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়, অনিয়মিত পিরিয়য়ডের সমস্যা দেখা দেয়।

এ ছাড়া কারো যদি কিডনিজনিত বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গ আক্রান্ত থাকে, দীর্ঘমেয়াদী ওষুধ খাওয়া, এরসঙ্গে মানসিক চাপ, হতাশা, উদ্বেগ এগুলোও রোগীর গর্ভধারণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

চিকিৎসা

ডা. হাবিব ইমতিয়াজ বলেন, চিকিৎসা হিসেবে রোগীকে প্রথমে কাউন্সিলিং করা হয় রোগ সর্ম্পকে। রোগ কতখানি তীব্র অর্থাৎ মৃদু, মাঝারি নাকি অতি তীব্র এর উপর নির্ভর করে রোগীকে কোন ওষুধ, কত দিনের জন্য কী ডোজে দেওয়া হবে। এ ছাড়া যেহেতু লুপাস অটোইমিউন রোগ, তাই ইমিউনোসপ্রেসিভ মেডিকেশনও দেওয়া হয় রোগীকে।

এ ছাড়া ফার্টিলিটি কাউন্সিলিং করা হয় নারীদের। তারা কখন গর্ভধারণ করতে পারবেন, কীভাবে গর্ভধারণ করবেন সেজন্য সন্তান নেওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লুপাসের চিকিৎসা জীবনব্যাপী। কিছু ওষুধ সারা জীবন সেবন করতে হয়, রোগের তীব্রতা ও জটিলতা এড়ানো এবং গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য।

লুপাস নিয়ে প্রয়োজন সচেতনতা

লুপাস রোগের চিকিৎসায় সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রোগীরা অনেকেই সমস্যাটিকে প্রথমে গুরুত্ব দেন না। ওষুধ কিছুদিন খাওয়ার পর ছেড়ে দেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে যান না। একই ওষুধ দীর্ঘদিন খাচ্ছেন, ওষুধের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে, ফলোআপে যেতে চান না। এসব ক্ষেত্রে রোগীর সচেতনতা জরুরি। তাই লুপাস রোগ সর্ম্পকে জানতে হবে, চিকিৎসা নিতে হবে সঠিক সময়ে এবং ফলোআপ চালিয়ে যেতে হবে।

তা না হলে রোগের তীব্রতা বেড়ে যাবে এবং হঠাৎ করে দেখা যায় কিডনি, ফুসফুস, মস্তিষ্কজনিত সমস্যাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে লুপাস মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করে। এ ছাড়া শরীরের কোনো অঙ্গ পুরোপুরি বিকল হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। যার মধ্যে অন্যতম খিঁচুনি, হঠাৎ করে চোখে দেখতে না পাওয়া, চোখের অপটিক নার্ভ শুকিয়ে যাওয়া, কিডনির ছাকনিতে প্রদাহ হওয়া, ফুসফুসে রক্তক্ষরণ থেকে শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি জটিলতা স্থায়ী ক্ষতির কারণ।

সেজন্য লুপাসের লক্ষণ সম্পর্কে জানা, কোন লক্ষণ মানে রোগের তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে সেটি বোঝা অত্যন্ত জরুরি।

 

Comments

The Daily Star  | English

123 ‘pushed in’ from India

Border Guard Bangladesh (BGB) yesterday detained at least 123 individuals, including Rohingyas and Bangla-speaking individuals, after India pushed them into Bangladesh through Kurigram and Khagrachhari border points.

43m ago